চাকুরীর জন্য শুধু সিভি নয় নিজেকেও তৈরী করতে হবে
এম এম মাহবুব হাসান: গত ১৮ বছরের অধিক চাকুরী জীবনে নিজে স্বেচ্ছাশ্রমে অনেক মানুষের সিভি তৈরী করে দিয়েছি। অনেকের চাকুরীও হয়েছে তাতে। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবৎ দেশি-বিদেশি সিভি রাইটার ও এইচআর প্রফেশনালদের বিভিন্ন পরামর্শ ও মার্কেটিং অ্যাপ্রোচে নিজে খানিকটা কনফিউজড হয়ে যাই।
কী আর করা, লকডাউনের মধ্যে বেশকিছু সফট স্কিলস ঝালাই করার পাশাপাশি সিভি, প্রোফাইল, বায়োডাটা ও রিজিউমের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে প্রফেশনাল সিভি রাইটার ও এইচআর প্রফেশনালদের বিভিন্ন উপদেশ বা পরামর্শের সাথে কোন কোন বিষয়ে একমত হয়েছি আবার কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।
তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো – সিভি তৈরীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ নিজেকে অল্প কথায় উপস্থাপন করা, নিজের স্কিলগুলোকে সাবলিলভাবে তুলে ধরা, পাশাপাশি নিজের অর্জন ও অন্যান্য যোগ্যতাগুলোকে সর্বোচ্চ মোট ২/৩ পৃষ্ঠার মধ্যে নিয়ে আসা। যদিও এটা কোন রকেট সাইন্স না- যে কেউ চাইলেই নিজের সিভি নিজেই তৈরী করে নিতে পারেন, তবে প্রফেশনালি যারা এই কাজগুলো করে থাকেন তারা হয়তো অতি সহজেই একটি সিভি বা রিজিউমকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সক্ষম।
এবার আসা যাক, সিভি বা রিজিউমের কার্যকারিতার দিকে। শুধু একটি ভাল সিভি বা রিজিউম হলেই কি কেউ কোন চাকুরীর ইন্টারভিউতে ডাক পাবেন? বা ভাল সিভি বা রিজিউম না হলে কি তিনি ডাক পাবেন না?
অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বেশ বড় আলোচনা হতে পারে। কেউ সুনির্দিষ্ট করে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ একজন তার অর্জিত দক্ষতা বা যোগ্যতাগুলো সিভিতে সাবলিলভাবে তুলে ধরতে না পারলেও তিনি তার বিভিন্ন জব রোলগুলো ঠিকই তুলে ধরে থাকেন যা একজন চাকুরীদাতাকে আকৃষ্ট করে থাকে। চাকুরীদাতা যখন তার আস্কিং জব রোলের বিপরীতে প্রার্থীদের মধ্যে থেকে একই জব রোলের অভিজ্ঞ প্রার্থী পেয়ে যান তখন তার সিভিটা বিবেচনায় নেন এবং পরবর্তীতে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়। এ ক্ষেত্রে যদিও অনেক প্রার্থী তার সিভিতে নির্দিষ্ট জব রোলের বাইরে অনেক কিছুই উল্লেখ করেন না – তবে ইন্টারভিউতে নিজের স্কিল ও অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে চাকুরিটি পেয়ে যান। সাধারণত অভিজ্ঞদের সিভিগুলো একটু হলেও ভাল করে দেখা হয়ে থাকে। তবে এটাও ঠিক যে শত শত সিভির মধ্যে আকর্ষণীয় ও সাবলিল ভাষায় উপস্থাপিত সিভিগুলোও প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
এবার আসা যাক ফ্রেশারদের দিকে। এখানে যেহেতু অভিজ্ঞতার বিষয়টি মুখ্য না সেহেতু এখানে চাকুরীদাতা দেখবে প্রার্থীর ইউনিভার্সিটি, সাবজেক্ট ও রেজাল্ট। তবে লেখাপড়ার পাশাপাশি যারা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত থাকেন সেগুলোকেও সিভিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করাটা জরুরী। সবকিছু বিবেচনার পর যারা ডাক পান তাদের জড়তাহীন উপস্থাপনা, আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ও ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো অনেক সময় আমলে নেওয়া হয়ে থাকে।
তাহলে একটি প্রশ্ন চলে আসে যে – অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবেদন করার পরে চাকুরীপ্রার্থীরা ইন্টারভিউতে ডাক পান না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক বড় হবে। মোদ্দা কথা – যখন কোন প্রার্থী তার নির্দিষ্ট জব রোলের বাইরে কোন জব খোঁজেন, চাকুরীদাতার জবের শর্তকে নিজের জব রোলের সাথে ফিট না করাতে পারা, নিজের সফট স্কিলগুলোকে যথাযথভাবে ফিট করাতে না পারা, চাকুরীদাতার জবের শর্তগুলো স্টাডি না করে হুটহাট করে আবেদন করা বা নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি জব রোলে ঢোকানোর চেষ্টার কারণেও অনেকে ইন্টারভিউতে ডাক পান না।
এ ক্ষেত্রে আরো একটি প্রশ্ন দেখা দেয় তা হলো – অনেকে ইন্টারভিউতে ডাক পাচ্ছেন কিন্তু চাকুরী পাচ্ছেন না, এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। তা হলো- চাকুরীর জন্য শুধু সিভি নয় নিজেকেও তৈরী করতে হবে। অনেকে চাকুরীদাতার শর্তমোতাবেক নিজেকে সিভির মাধ্যমে চকচকে ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে চান। যা দেখে অনেক চাকুরীদাতা তাকে পরবর্তী ধাপে না ডেকে পারেন না। কিন্তু বিপত্তিটা বাধে ইন্টারভিউ বোর্ডে – অর্থাৎ আকর্ষণীয় সিভির মানুষটি নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারেন না বা সিভিতে উল্লেখিত স্কিল ও অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশ্নগুলোর উত্তরগুলো আত্মবিশ্বাসের সাথে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বা প্রশ্নকর্তাদের খুশি করতে পারছেন না, চাকুরীর ইন্টারভিউতে ডাক পেলেও এগুলো চাকুরী না পাওয়ার কারণ হতে পারে।
একজন চাকুরী প্রার্থীকে সিভিতে ও বাস্তবে উপস্থাপনের জন্য পরামর্শগুলো কী হতে পারে?
আসলে একজন চাকুরী প্রার্থীকে বা একজন মানুষকে ২/৩ পৃষ্ঠার একটি সিভিতে কখনোই পুরোপুরি উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে সিভিকে একজন চাকুরী প্রার্থীর ‘কোর্স অফ লাইফ’ বলা হয়ে থাকে, যা দেখে একজন চাকুরীদাতা এমন একটি ধারণা পোষণ করতে পারেন যে – হয়তো এই প্রার্থীই আমাদের কাঙ্ক্ষিতদের একজন হবেন। এই প্রাথমিক বিশ্বাসটির জন্ম মূলত একটি সিভিই দিতে পারে। কিন্তু সিভির মানুষটিকে বাস্তবে হতে হবে চাকুরীদাতাদের ধারণার থেকেও অভিজ্ঞ, দক্ষ ও যোগ্য- যা ইন্টারভিউ বোর্ডের বিভিন্ন প্রশ্নের বিপরীতে সাবলিল ও আত্মবিশ্বাসী উত্তরদানের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। কিন্তু অনেক সময় সিভির প্রার্থী ও বাস্তবের প্রার্থী ভিন্ন হয়- যা চাকুরীদাতাদের হতাশ করে। সেজন্য যে কোন চাকুরীর আবেদনের আগে নিজেকে ঐ চাকুরীর একজন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তৈরী করতে হবে। নিজের কারিগরি ও সফট স্কিলগুলোকে ঝালাই করতে হবে, নির্দিষ্ট জব রোল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে, ইন্ডাস্ট্রি এবং চাকুরীদাতা কোম্পানী সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা রাখতে হবে।
লেখক পরিচিতি: এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার