ম্যাজিস্ট্রেটের উস্কানিতেই বিজিবি নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে
প্রদীপ মোহন্ত, (বগুড়া):
বগুড়ায় গাবতলী উপজেলার কালাইহাটা গ্রামে ভোটের দিন বিজিবির গুলিতে নারীসহ ৪জন নিহতের ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কালাইহাটা বাজারের দোকানপাট বন্ধ রেখে গ্রামের লোকজন বাজারে অবস্থান করছেন। সকাল থেকে গ্রামে প্রবেশ করেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য। দুপুরে নিহত চারজনের মরদেহ ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জীবন ও নির্বাচনী সামগ্রী রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন কালাইহাটা গ্রাম ঘুরে দেখা যায় স্থানীয় জনগণ চরম উত্তেজিত। তারা সংবাদ কর্মীদের দেখলেই ‘ম্যাজিস্ট্রেটের ফাঁসি চাই’ বলে শ্লোগান দিচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বুধবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। কালাইহাটা বাজার ছাড়াও শত শত মানুষ ভিড় করছে নিহতদের বাড়িতে এবং কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে। ভোট কেন্দ্রের মাঠ জুড়ে পড়ে আছে অংসখ্য ইটপাটকেল আর ভাঙা কাঁচের টুকরো। প্রিসাইডিং অফিসারের ও ভোট গণনার কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভোটের পরের দিন শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এলেও ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আসেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউছুফ আলী বলেন- ভোটের দিন সন্ধ্যায় গুলিতে ৪ জন মারা যাওয়ার পর আতংকে ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসেনি। তবে গ্রামবাসীর অনেকেই দাবি করছেন, দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের উস্কানিতেই বিজিবি নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
ভোটারদের অনেকেই দাবি করেন, উত্তেজনার এক পর্যায়ে ইউএনও আসিফ আহমেদ এর নির্দেশে দফায় দফায় গুলি ছোঁড়ে বিজিবি-পুলিশ। আর তাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন কালাইহাটার ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রশীদ, খোরশেদ হোসেন, ৪০ বছর বয়সী কুলসুম আক্তার ও আলমগীর হোসেন।
বুধবার ভোট গ্রহণ শেষে এমন ঘটনার কারণ জানতে চাইলে কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান বলেন, “ভোট কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ। তিনি বিকেল ৫টার দিকে বিজিবিসহ ভোট কেন্দ্রে ঢোকেন। এসময় ভোট কেন্দ্রের বাইরে সবগুলো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অবস্থান করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে বসেই লোকজন সরিয়ে দিতে বিজিবিকে নির্দেশ দেন। লোকজন ফলাফল না নিয়ে যাবে না এমন কথা বললে বিজিবি সদস্যরা প্রথমে নারী সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে উপস্থিত লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এর এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।”
একই গ্রামের বাসিন্দা ফয়জাল প্রামানিক বলেন,“ ভোট কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করে ব্যালট পেপার উপজেলা সদরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমন খবরে লোকজন উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। এসময় বিজিবি সদস্যরা লাঠিচার্জ করলে জনগণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যরা প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে আশ্রয় নেন। সেই কক্ষ থেকেই বিজিবি সদস্যরা গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান নারীসহ চারজন।”
বালিয়াদীঘির কালাইহাটার সাবেক সদস্য বাবলু জানান, “ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে সব লোকজনকে ডেকে এই কেন্দ্রেই ভোট গণনা করে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা কথা জানান। কিন্তু নৌকা প্রার্থীর লোকজনেরা তা মানতে চাননি। পরে ম্যাজিস্ট্রেট যখন ব্যালট বাক্স নিয়ে সদরে যেতে চাইলে স্থানীয়রা আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। গাড়ি ভাঙ্গে। রাস্তা আটকে রেখেছিল। ওই সময় গুলি করে। ”
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি অধ্যুষিত বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের মালিয়ান ডাঙ্গা এবং কালাইহাটা গ্রামে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি। কালাইহাটা ভোট কেন্দ্রের ফলাফলের ওপর নৌকা মার্কার জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল। সেই কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে নৌকা মার্কার কর্মী সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা ভোট কেন্দ্রে হামলা করে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়ে। পরে রাত ১০ টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলাফলে নৌকা মার্কার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ও শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ বলেন, “জনগণকে শান্ত করতে সেখানে আমার দেওয়া বক্তব্যের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড আছে।, জনগণ শান্তি বজায় না রেখে সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।’ তিনি বলেন- অন্য ৮ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন তারা। একপর্যায় কয়েকশ’ নারী ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে আমার গাড়িসহ বিজিবির ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, ভোট কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষের দরজা জানালা ভাঙচুর করে তছনছ করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা আত্মরক্ষার্থে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান নেয়। বিক্ষুদ্ধ লোকজন সেই কক্ষে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ভেঙে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্যরা গুলি বর্ষণে বাধ্য হন বলে উল্লেখ করেন তিনি।”
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, “সেখানে নিহত কালাই হাটা গ্রামের খোরশেদ হোসেন (৬০), আব্দুর রশিদ (৫৫), আলমগীর হোসেন (৪৫) ও কুলসুম আক্তারের (৫৫) মরদেহ ময়না তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ভোট কেন্দ্রে হামলা এবং ৪ জন নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মামলা হয়েছে। তবে ওই কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রিসাইডিং অফিসার বাদি হয়ে মামলা করেন বলে উল্লেখ করেন ওসি।”
বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুব আলম শাহ বলেন, “কোন পরিস্থিতিতে কারা ছুঁড়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে। আশ্বাস দিয়েছেন সুষ্ঠু তদন্তের।”
যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার জেলা প্রাশাসক জিয়াউল হক বলেন, “অন্যান্য কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে কালাইহাটা কেন্দ্রের ভোট গণনা করতে হবে এমন দাবি না মানায় প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট কেন্দ্রে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী ও নিজেদের জীবন রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা সেখানে গুলি ছোড়ে।”