শিরোনাম

South east bank ad

মানবিকতার প্রশংসায় ভাসছেন দিয়াকুল উপজেলার মানুষ

 প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

মোঃ রাজু খান, (ঝালকাঠি):

মোসা. মুক্তা আক্তার, বড় বোন মুন্নি বেগম ও তার বড় ছেলে ফাহিম, ৬মাস বয়সী পুত্র আব্দুল্লাহ আল ইয়ামিন এবং চাচাতো বোন ফাতেমা আক্তার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন শীতের অবকাশ কালীন সময় অতিবাহিত করবেন।

খেজুর রসের পীঠা-পায়েস খাবেন, আনন্দ ফুর্তি করবেন। অভিযান লঞ্চে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ায় সেই আশা পুরণ হলেও হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন আর প্রশংসা করছেন দিয়াকুলবাসীর। আগুনের লেলিহান শিখা ধাউধাউ করে জ¦লে লঞ্চটির যাত্রীসহ পুড়ে যাচ্ছিলো। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে দিয়াকুলের চড়ে ওঠে। স্থানীয়রা আগুন দেখে তাঁদের জীবনের ঝুকি নিয়ে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।

আমরা যেভাবেই হোক, আল্লাহর পরে স্থানীয়দের সহায়তায় বেঁচে আছি। ওই এলাকার লোকজন যদি সহায়তা না করতো তাহলে আমরাও মনে হয় বাচঁতে পারতাম না, নিহতের সংখ্যাও আরো বেড়ে যেতো। এমনভাবেই জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে স্থানীয়দের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকার একটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নার্সিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তার।

মোসা. মুক্তা আক্তার জানান, সদরঘাট টার্মিনালে বিকেল ৫টার দিকে উঠে দ্বোতলায় সামনের দিকে আসন নেন। মনের খুশিতে গ্রামের বাড়ি যাবার সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন। সাড়ে ৫টা বাজলেই লঞ্চে প্রচুর পরিমাণে লোক ওঠে। যারাই ইঞ্জিন রুমের কাছে বিছানা করতে যান, প্রচন্ড গরমের কারণে তারাই ফেরত আসেন। এ অবস্থায় প্রায় আড়াই হাজার (আনুমানিক) লোক নিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় লঞ্চ ছাড়ে।

এরপর চাঁদপুর ও বরিশাল থেকেও প্রচুর পরিমাণে লোক তুলে। যেন তিল ধারণেরও ঠাই ছিলো না লঞ্চটিতে। ওদিকে লঞ্চের তপ্ততাও বাড়তে থাকে। আমরা স্টাফকে বারবার বললেও তারা আমাদের কথায় কো

ন ভ্রুক্ষেপ করেনি। ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের কাছাকাছি আসলেই ধোয়ায় অক্সিজেন সংকটে শ্বাসকষ্টে যাত্রীরা ছোটাছুটি শুরু করে। এসময় আমরা পাশে গিয়ে মাথা বাহিরে দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করি, ওদিকে গরমে আমাদের পিছন পুড়ে যাচ্ছে।

উপায়ন্ত না পেয়ে আমি ঝাপ দিয়ে বোন ফাতেমাকে বের হতে বলি। তাকেও টেনে বের করে ছোট বাচ্চাটাকে লঞ্চের একযাত্রীর সহায়তায় নামিয়ে আনতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি। বড় বোনকে বের হতে বললে সে ঝাপ দেয়ায় তীরে কাদা-পানির মধ্যে পড়ে যায়। এতে তার দু’ পা ভেঙে যায় এবং কোমড়ে প্রচন্ড আঘাত লাগে। তাকেও খুজে পাচ্ছিলাম না। বোনের বড় ছেলেটা হারিয়ে যায়।

আমাদেরকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে ট্রলারে নিয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে পৌছে দেয়। আরো দুজন অগ্নিদগ্ধসহ পরে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় বাচ্চা দুটিকে ফিরে পাই। ছোট বাচ্চাটা পানিতে ভিজে যাওয়ায় তার পোশাকও পরিবর্তন করে দেয় স্খানীয়রা। বড় বাচ্চাটার হাত আগুনে পুড়ে যায়।

সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বড় বোন মুন্নি বেগমের কাছে পৌছে দেন। পরে উন্নত চিকিৎসার চিকিৎসার জন্য বড় বোনকে সদর হাসপাতাল থেকে বরিশাল হাসপাতালে (শেরই বাংলা চিকিতসা মহাবিদ্যালয়) প্রেরণ করে। বাচ্চা দুটিও এখন বড় বোনের কাছে আছে। আমরা দু'বোন (মুক্তা ও ফাতেমা) সদর হাসপাতালে ভর্তি আছি।

মুক্তা ও ফাতেমা জানান, জীবনে এমন বিপদে আর কখনোই পড়ি নাই। কিভাবে মানুষ পোড়ে, পোড়া মাংস কিভাবে খসে খসে পড়ে তাও দেখলাম। নিজেও পুড়েছি, বোনও পুড়েছে এবং সেই মারাত্মক পোড়া মানুষের সাথেই ট্রলাওে হাসপাতালে আসতে হয়েছে। নদীর পাড়ের স্থানীয় মানুষ যেভাবে আমাদের সহায়তা করেছে তাতে তাঁদের ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না বলে দুচোখের পানি ছেড়ে কেঁদে দেয়।

ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের সময় যাত্রীদের উদ্ধার ও সাঁতরে তীরে আসা যাত্রীদের গরম পোশাক দিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়ান সদরের দিয়াকুল গ্রামের মানুষ। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে লঞ্চে আগুন লাগার পরপরই এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা কুয়াশা আর প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে সুগন্ধা নদীতে ঝাঁপ দেন যাত্রীদের বাঁচাতে।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, ঘটনার পরপরই দিয়াকুলের লোকজন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ কল করেন। তবে তাঁরা সহায়তা পাননি। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকালে। কিন্তু গ্রামের লোকজন রাতেই উদ্ধারকাজে হাত লাগান।

অনেকেই ট্রলার নিয়ে লঞ্চের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করেন, যদিও আগুনের তাপের কারণে তাঁদের পক্ষে লঞ্চে উঠে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। পরে লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া যাত্রীদের ট্রলারে করে তাঁরা নদীর তীরে নিয়ে যান। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। ভেজা কাপড় পাল্টে তাঁরা যেন গরম কাপড় পরতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করেন।

দিয়াকুল গ্রামের যুবক রুশাদ ও শাকিল জানান, অভিযান-১০ লঞ্চ থেকে যখন শিশুদের চিৎকার ভেসে আসে, তখন তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে যান তাঁরা। বড়রা যখন তাঁদের জীবন বাঁচাতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ছিলেন, তখন দুটি শিশু লঞ্চ থেকে চিৎকার করছিল। এই দৃশ্য দেখে একটি ট্রলার নিয়ে ওদের বাঁচাতে এগিয়ে যাই। তাদের ট্রলারে উঠিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি শিশু আগুনের তাপে দুর্বল হয়ে নদীতে পড়ে যায়। আরও কয়েক শিশুকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে যেতে দেখলেও তাদের রক্ষা করতে পারিনি। আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। শুধু চোখের পানি ফেলেছি দূর থেকে।’

লঞ্চের বেঁচে ফেরা একাধিক যাত্রীর ভাষ্য, ঝালকাঠি শহরের কাছে আসতেই লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ পাড়ে ভেড়ানোর চেষ্টা করেনি। পরে আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়লে সদরের চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন লঞ্চটির চালক। কিন্তু সেখানে লঞ্চটি ভেড়াতে পারেননি। ওপারের দিয়াকুল গ্রামে গিয়ে লঞ্চটি ভেড়ে। তবে চর ভাটারকান্দা গ্রামের দুই শতাধিক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

লঞ্চযাত্রী বরগুনার লাকুরতলার আহসান হাবিব বলেন, সেই রাতে দিয়াকুল গ্রমের মানুষ যে মানবিকতা এবং উদারতা দেখিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবার মতো। তাঁরা সময়মতো উদ্ধারকাজে নেমে পড়ায় অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। তাঁরা গরম কাপড়, টাকা ও খাবার দিয়ে সহায়তা করেছেন।

চর ভাটারকান্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী বৃৃষক হেমায়েত হোসেন বলেন, লঞ্চটি চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে আটকাতে পারলে হতাহতের সংখ্যা আরও কম হতো। চর ভটারকান্দার মানুষ দুই শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদে পাড়ে পৌঁছে দিয়েছেন।

ঝালকাঠি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা, উদীয়মান তরুণ সমাজসেবক হুমায়ূন কবির সাগর চারটি ট্রলার ভাড়া করে দেড় শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধারে তৎপরতা চালান।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আগুন, আগুন বলে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হই। দেখি, দক্ষিণ দিকের আকাশ লাল।
নদীর মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে একটি লঞ্চ। তখন বুঝতে পারি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগেছে। দ্রুত ছোটাছুটি করে এলাকার ছোট ভাইদের ডাকি। একে একে এলাকার ২৪/২৫ জন আমার সঙ্গে বের হন। ওদের নিয়ে চারটা ট্রলার ভাড়া করে লঞ্চের দিকে যাই। তবে আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারছিলাম না। কিন্তু লঞ্চ থেকে অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রলারের দিকে সাঁতরে আসেন। আমরা তাঁদের ট্রলারে তুলতে থাকি। দেড় শতাধিক যাত্রীকে নদীর তীরে নিয়ে আসি।”

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: