এলপিজির দাম নির্ধারণ : আবারো গণশুনানির উদ্যোগ
বেঁধে দেয়া মূল্যে বেশকিছু খাতে ব্যয় বিবেচনায় নেয়া হয়নি এমন দাবি এলপিজি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব)। এ খাতের ব্যবসায় আসা করপোরেট অপারেটরদের মধ্যে রয়েছে ইস্ট কোস্ট, এনার্জিপ্যাক, বসুন্ধরা, মেঘনা, বেক্সিমকো, যমুনা, ওরিয়ন, ইয়ুথ গ্রুপসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিদেশী অপারেটরও রয়েছে খাতটিতে। এর মধ্যে টোটাল গ্যাস ও লাফজ গ্যাস অন্যতম। অপারেটরদের দাবি, মজুদ ও বোতলজাত, ডিস্ট্রিবিউটর ও রিটেইলারদের জন্য নির্ধারিত কমিশন বাবদ যে ব্যয় ধরে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে এলপি সিলিন্ডার বাজারজাত সম্ভব নয়। এসব খাতে খরচের পরিমাণ আরো বেশি। একটি সিলিন্ডারে গ্যাস বাজারজাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত ৫০ টাকার অতিরিক্ত আরো ১০০-১৫০ টাকা খরচ হয়। বেসরকারি এলপিজির দাম নির্ধারণে জাহাজ ভাড়া, ফ্রেইট, ইমপোর্ট প্যারিটি চার্জ, এলপি গ্যাস মজুদকরণ, বোতলজাত, ডিস্ট্রিবিউটর চার্জ ও রিটেইলার চার্জ বিবেচনায় নেয় কমিশন। এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে বেসরকারি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়। যদিও অপারেটরদের দাবি, বোতলজাত, ডিস্ট্রিবিউটর খরচ, রিটেইলার খরচ কমিশন কম ধরেছে।
বেসরকারি খাতের বিপণন করা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১১ জানুয়ারি গণশুনানির আয়োজন করেছিলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) । এর ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো এলপিজির মূল্য বেঁধে দিয়ে ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আদেশ জারি করে। এরপর তিন দফায় এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়। যদিও নির্ধারিত দামে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছেনি পণ্যটি। তবে তিন মাসের মাথায় এলপিজি বিপণনকারী বেসরকারি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবারো গণশুনানির উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন।
মূল্য নির্ধারণের আগে বিইআরসির কাছে দেয়া প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছিল, ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা করা হলে পণ্যটি লাভজনকভাবে বিপণন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউটর ব্যয় ও লাভ ধরা হয় ৫০ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার ব্যয় ও লাভ ধরা হয় ৮০ টাকা। বোতলজাতসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২০ টাকার মতো।
লোয়াবের সভাপতি এবং ওমেরা এলপিজির পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, কমিশন যে দাম ঘোষণা করছে সেখানে ডিস্ট্রিবিউটর ও রিটেইলার খরচ বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আরো খরচ রয়েছে, এ খরচগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে হলে এটা কোনোভাবেই বাদ দেয়া যাবে না।
এলপিজি খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন উল্লেখ করে লোয়াব সভাপতি বলেন, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে স্বল্প মুনাফায় গ্রাহকের কাছে পণ্যটি পৌঁছে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন কোম্পানি ব্যাংকঋণ নিয়ে এ ব্যবসায় নেমেছে। তাই ব্যাংকের সুদ বাবদ ব্যয়ও গুনতে হচ্ছে তাদের।
মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেশকিছু খরচ বিবেচনায় নেয়নি বলে জানান বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল। তিনি বলেন, খুচরা বিক্রেতাদের ব্যয় ৫০ টাকা ধরা হলেও সিলিন্ডারপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এটি আমলে নেয়া হয়নি। বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বাস্তবায়ন করতে হলে ভোক্তাদের স্বার্থ যেমন দেখতে হবে, তেমনি অপারেটরদের বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
এলপি গ্যাস খাতের আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান যমুনা এলপি গ্যাসের পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত বলেন, প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে থাকতে হলে সবদিকই বিবেচনায় নিতে হবে। এ খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছি বলে আমাদের সমস্যাগুলো কমিশনকে জানিয়েছি। গণশুনানিতে এগুলোর প্রতিফলন ঘটলে খাতটির আরো সম্প্রসারণ ঘটবে।
সৌদি আরামকোর চুক্তি মূল্য (সিপি) অনুযায়ী দেশের বাজারে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ হচ্ছে। তবে মূল্য ঘোষণার ক্ষেত্রে সৌদি আরামকোর এক মাস আগের দাম বিবেচনায় নেয় কমিশন। অর্থাৎ জুনে এলপিজির দাম নির্ধারণে মে মাসের সিপিকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আমদানি করায় এ প্রক্রিয়া মূল্য নির্ধারণ জটিলতা তৈরি করছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির বর্তমান মূল্য বেশি হলেও দেশে বিক্রি করতে হচ্ছে এক মাস আগের দামে। চলতি মূল্যে এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হলে এ সংকট থাকবে না বলে মনে করছেন তারা।
তবে কমিশন বলছে, বর্তমান সিপি অনুযায়ী এলপিজির দাম নির্ধারণে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ দেশে এলপিজি আমদানির বড় উৎস দেশ হলো সৌদি আরব, কাতার, দুবাই ও ওমান। সৌদি সিপি ঘোষণার পর দেশগুলো থেকে পণ্য আসতে ৮-১০ দিন সময় লাগে। এরপর আমদানি করা এলপিজি বোতলজাত ও বিপণনে আরো তিন-চারদিন সময় লেগে যায়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, সরকার এলপিজির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারত। এর মধ্যে তাদের মুনাফা করার সুযোগ রাখা যেত। তাহলে এলপিজির বাজারে একটা ভারসাম্য তৈরি হতো। তবে বিইআরসির এ উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে কিনা দেখার জন্য অপেক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ কভিডের কারণেও এ প্রক্রিয়া কার্যকর করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) করা এক রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল বেসরকারি এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। এর আগে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতেন। কমিশন দাম নির্ধারণের পর থেকে বেশি দামে এলপি গ্যাস বিক্রির সুযোগ না থাকলেও বাজারে সেই দাম কোনোভাবেই কার্যকর হয়নি। প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের যে মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে, বাজারে তা থেকে ১০০-২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বিইআরসি মে মাসে ১২ কেজি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে ৯৭৫ টাকা। যেখানে সিলিন্ডারে ডিস্ট্রিবিউটর খরচ ধরা হয় ২৪ টাকা ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচ ধরা হয় ২৭ টাকা। এছাড়া বোতলজাত ও মজুদকরণের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১৪৩ টাকা।
গণশুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি সদস্য (গ্যাস) মকবুল ইলাহি চৌধুরী বলেন, ১৮টি এলপি গ্যাস কোম্পানি কমিশনের এলপি গ্যাসের দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তারা বেশকিছু খরচ বিবেচনায় নেয়ার কথা বলছে। এজন্য আমরা গণশুনানির আয়োজন করেছি। শুনানিতে তাদের যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করলে সেটি টেকনিক্যাল কমিটি পুনর্মূল্যায়ন করবে।
উল্লেখ্য, এলপিজি খাতে ব্যবসা পরিচালনায় বিইআরসির কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে মোট ২৮টি কোম্পানি। এর মধ্যে বর্তমানে বিপণন কার্যক্রম চালু রয়েছে ১৮টির।