বাষট্টিতে নেহেরুর সাড়া না পেয়ে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু: হাসিনা

ষাটের দশকের শুরুতে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন যখন দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, সে সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সেই যাত্রায় তার জওহরলাল নেহেরুর সাড়া না পাওয়া নিয়ে সাড়ে পাঁচ দশক পর কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীন হওয়ার চেষ্টায় বাঙালির সেই পরিকল্পনার আঁচ পেয়ে ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে পাকিস্তান সরকার। গণআন্দোলনের মুখে পরের বছর সেই মামলা প্রত্যাহার করতে তারা বাধ্য হয়।
শেখ মুজিবের সেই আগরতলা যাত্রার নয় বছর পর বাঙালির সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
সেই ভাষণের পর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে নৃশংস গণহত্যা। আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ওপর শুক্রবার ঢাকায় এক সেমিনারে বাঙালির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “একটা পর্যায়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) কিন্তু ৬২ সালে (১৯৬২) আগরতলা গিয়েছিলেন। এটাও বাস্তবতা। তিনি গিয়েছিলেন; একটা প্রস্তুতি নেবার জন্য। কিন্তু যে কারণেই হোক নেহেরু সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন… তার কাছ থেকে তেমন কোনো একটা সাড়া না পেয়ে তিনি ফেরত চলে আসেন।”
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তখন ১৫ বছরের কিশোরী। তিনি স্মরণ করেন, আগরতলায় গোপন ওই সফর শেষে ফিরেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
“কারণ, তার আগে চার পাঁচ দিন তিনি অনুপস্থিত… পাকিস্তানি গোয়েন্দারা পাগল হয়ে গেছে; উনাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে খোঁজ নিতে চেষ্টা করেছে তারা।”
‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’ বইয়ে আগরতলা মামলার পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুনতাসীর মামুন ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ‘বিদ্রোহ’ পরিকল্পনা নিয়েও লিখেছেন।
সেখানে বলা হয়েছে, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তাতে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সম্মতিও ছিল। তবে এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ ছিল তার।
একাত্তরে বাঙালি যখন মুক্তিযুদ্ধে, নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে নানাভাবে তিনি সহযোগিতা করেন।
বাংলাদেশের প্রায় কোটি মানুষকে সে সময় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেয় ভারত। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কর্মকাণ্ড তখন পরিচালিত হত কলকাতা থেকেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা শহীদ হয়েছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে।
ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর সেই আগরতলা সফর ফলপ্রসূ না হলেও পরের বছরগুলোতে বাঙালির সংগ্রাম ধীরে ধীরে সশস্ত্র লড়াইয়ের পথেই গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় সেখানে। মামলায় বলা হয়, ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ওই ‘ষড়যন্ত্রের’ সূচনা হয়।
সে সময়ের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা সেমিনারে বলেন, ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার বিষয়টি পরিবারের বাইরে খুব বেশি মানুষ জানত না।
“শুধু মা আর আমরা কয়েক ভাই-বোনই জানতাম। আর কারো জানার কথা ছিল না। আর যারা সহযোগিতা করে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল; তারা দুই-একজন জানতেন। ওই সূত্র ধরেই তারা মামলাটা দিয়েছিল। সে মামলা দিয়ে তারা কিছুই করতে পারে নাই।”
কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত এই সেমিনারে শেখ হাসিনা তার ৫৫ মিনিটের বক্তৃতায় একাত্তরপূর্ব ইতিহাসের নানা বিষয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আমাদের দেশের মানুষের জানার এখন অধিকার আছে। আমি নীরব সাক্ষী। আর ওই পরিবারের তো আমরা দুজনই বেঁচে আছি। ওখানকার ঘটনা আমরা যা জানি, আর কে জানবে?”
সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের ভূমিকার কথা স্মরণ করে আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকারি কর্মকর্তাদের একটা বিরাট গ্রুপ উনার (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে ছিলেন; তারা প্রতিটি কাজে সব সময় গোপনে সহযোগিতা করে যেতেন। তাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় মিটিংও হত। অনেক সময় লঞ্চে করে চলে যেতেন, সেখানে মিটিং হত।”
পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার বাঙালি কর্মকর্তারা কীভাবে সে সময় বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করতেন, সে কথাও শেখ হাসিনা বলেন।
“তারা সব সময় সহযোগিতা করত। অনেকে গোপনে এসে আব্বার সাথে দেখা করে যেতেন, মায়ের সঙ্গে দেখা করতেন, রিপোর্ট দিয়ে যেতেন। যেভাবে তিনি নির্দেশ করতেন, সেভাবেই তারা রিপোর্ট করতেন।”
“তারা কখনও রিপোর্ট দেয়নি যে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। সব সময় দিয়েছে- ২০ দল অনেক সিট পাবে, কোনো চিন্তা নাই। এভাবেই তারা রিপোর্ট দিয়ে সহযোগিতা করেছে।”
সেই আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পূর্ব পাকিস্তানে দুটি ছাড়া সব আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। কিন্তু শেখ মুজিবের দলকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে অ্যাসেম্বলি ডাকতে দেরি করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এই প্রেক্ষাপটে সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন এবং ২৫ মার্চ শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট।
সেই রাতের ঘটনা মনে করে শেখ হাসিনা বলেন, “দুপুর দেড়টার দিকে একজন স্কুটার ড্রাইভার.. সে আমাদের বাসায় এসে ছোট একটা চিরকূট দিল। সে ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসছিল। ক্যান্টনমেন্টের এক বাবূর্চি তাকে ওই চিরকূটটা দেয়। তাতে হাতে লেখা ছিল, আজকে রাতে ১টার সময় পাকিস্তানিররা আমাদের ওপর আক্রমণ করবে।… আক্রমণটা তারা করেছিল ১১টার দিকে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তা ইয়াহিয়া খান আসলে ভাবতে পারেননি।
“আর ভুট্টো সাহেবও (জুলফিকার আলী ভুট্টো) খেলা শুরু করে দিল। ভুট্টোকে এক সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তুমি যাদের হাতের ক্রীড়ানক হয়েছ, আজকে তোমাকে নিয়ে তারা খেলবে। আমাকে যেদিন শেষ করবে, তুমিও সেদিন বাঁচবা না’।”
বঙ্গবন্ধুর সেই হুঁশিয়ারিই সত্যি হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে তাকে এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। আর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা ভুট্টো সামরিক অভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত হন; সামরিক আদালতের বিচারে ১৯৭৯ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
সাতই মার্চের ভাষণ ঘিরে তখনকার ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “ওই সময়ে আমাদের কিছু কিছু ছাত্র নেতা… তার মধ্যে অন্যতম সিরাজুল আলম খান আর তার সাথে তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ… তারা দোতলায় দাঁড়িয়ে আব্বাকে খুব বোঝাচ্ছেন যে, লিডার আজকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মানুষ নিরাশ হয়ে চলে যাবে।
“আব্বা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, ‘সিরাজ কী করতে হবে আমি খুব ভালো জানি। লিডার শ্যুড লিড দ্যা ল্যাড। ল্যাড শ্যুড নট… তোমরা প্রস্তুত থাক। তোমাদের কিছু করতে হবে না। কী করতে হবে সেটা আমি জানি।”
সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলে কূটনৈতিকভাবে বিশ্বে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসাবে পরিচিতি পেতেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না, তার (সিরাজুল আলম খান) এই কথাটা বলার পিছনে কী ছিল… এটা তো ঠিক, পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টারে বোমা নিয়ে তৈরি।
“যখনই ঘোষণা দেবে, তারা বোমা মেরে ব্রাশ ফায়ার করবে। জালিয়ানওয়ালাবাগে (ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে ব্রিটিশ বাহিনীর হত্যাকাণ্ড) যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করত। আর কোনোদিন যেন আন্দোলন মাথাচাড়া দিতে না পারে।”
সাতই মার্চের ভাষণের পর রেসকোর্স থেকে বাসায় ফিরে সিরাজুল আলম খানের দেখা পান বলে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছি। তখনই দেখি সিরাজুল আলম খানসহ আমাদের কয়েকজন ছাত্র নেতা… সিরাজুল আলম খান বলছেন, ‘লিডার কী করলেন? আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আসলেন না? মানুষ সব ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে চলে গেছে’।
“আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন কেন? আমি নিজেই তো সাক্ষী। আমার সাথে রেহানা আছে, ওয়াজেদ সাহেব আছে। কেউ তো ফ্রাস্ট্রেটেড না। মানুষ তো মনে হল যেন খইয়ের মত ফুটছে।”
রেসকোর্স থেকে বাসায় আসার পথে স্বাধীনতাকামী মানুষের জনস্রোত আর মিছিলের উদ্দীপনা দেখার কথা তখন বঙ্গবন্ধুর সামনে তুলে ধরেন তার মেয়ে।
“আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা আপনি বিশ্বাস করবেন না, মানুষের মধ্যে যে উদ্দীপনা আমরা দেখলাম.. উনারা কিছু দেখেন নাই, সোজা আপনার সাথে এসে এই মিথ্যা কথাগুলো বলে যাচ্ছে।”
সেদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে দলের ভেতরে ওই চাপের উদ্দেশ্য কী ছিল- সেই প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিছু লোক বক্তৃতার আগে পরামর্শ, বক্তৃতার পরে এই কথা বলার পেছনে কী রহস্যটা থাকতে পারে, সেটা ৭৫ এর পরে বা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখলে এখন মনে হয়। তারা যে সব সময় একটা ষড়যন্ত্রের সাথে ছিল; সেটা কিন্তু বোঝা যায়।”
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন এশিয়ান এজের সহযোগী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভগের অধ্যাপক আকসুদুল আলম।