শিরোনাম

South east bank ad

‘বাবার কাঁধ’

 প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সাহিত্য

এম এম মাহবুব হাসান:  ডাইনিং স্পেসে তুমুল চিৎকারে সাড়া দিতে নিজের রুমের নিরবতা ভাঙতে বাধ্য হলাম। এ কি! আভা চিৎকার করেই যাচ্ছে, আমাকে দেখা মাত্রই বাবা...বাবা.. বলে আরো জোরে চিৎকার! সে কি তবে বলতে চাইছে - ‘বাবা তুমি ছাড়াও আমাকে কাঁধে নেওয়ার মতো কেউ আছে। তাও যেনতেন কাঁধ নয়, বড় ভাইয়ের কাঁধ, বুঝলে’। বাহ্ , আভার অবুঝ মন যদি ওকে সত্যি সত্যিই এটি ভাবাতো তাহলে সেটি হতো দারুণ গর্বের চিৎকার। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মেয়েরা সাধারণত অন্যের কাঁধে ভর করে অভ্যস্থ। আভাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাবার কাঁধের পাশাপাশি নতুন কাঁধের আবিষ্কারকে হয়তো আভা নিজের অর্জন হিসেবেই দেখছে। সেজন্য এমন গলাবাজির ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। সত্যি বলতে কি- একটি মেয়েকে অনেকগুলো কাঁধের উপর দিয়ে তার পুরো জীবনকে চালিয়ে নিতে হয়। এরমধ্যে কোনো একটি কাঁধও যদি সামান্যও নড়বড়ে হয় তাহলে তার জীবনটা অসামান্য নড়বড়ে হবার চান্স থাকে। জীবন বলতে শুধু বাহ্যিক জীবন নয়, এটি সাধ ও সাধ্যের মধ্যে কাঙ্খিত মর্যাদাপূর্ণ একটি সুখের জীবন। আভার উচ্ছ্বোসিত হবার বিষয়টি না হয় বুঝলাম। কিন্তু মাহিব? মাহিবতো আভাকে কাঁধে নিয়ে বেশ কষ্ট করে যাচ্ছে। এই কষ্টের মধ্যেও সে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে কেনো? মাহিবও কি আমাকে কোনো ম্যাসেজ দিচ্ছে, যেমনটি ধরা যাক- ‘ দেখো বাবা তুমি আগে আমাকে কাঁধে করে কতো খেলা করতে, পার্কে নিয়ে যেতে, হাতিরঝিলে ঘুরাতে, এখনতো কাজের বাইরে আমাদের সময়ই দাওনা, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? আজ দেখলেতো আমিও কাঁধে চড়ানো শিখে গেছি, যতোটা তুলতুলে মাহিব মনে করো আমি অতোটা তুলতুলে না বাবা, দেখছো না বোনকে কাঁধে নিয়ে কেমন শক্ত করে দাঁড়ানো শিখে গেছি, আর তোমার মত হতে হতে আরো কতো শক্ত হবো সেতো তুমি নিজের চোখেই দেখবা।’ ও কি আসলেই এমন কিছু ভাবছে? তাহলেতো আমি ভারমুক্ত হওয়ার পথে, সিরিয়াসলি। 7 মাহিবের কাঁধে চড়ানোর ঘটনাটি হঠাৎ বাবার কথা স্বরণ করিয়ে দিলো। আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। বাবা আমাকে বারো মাইল দূরের পথ পাড়ি দিয়ে শহরের কালিপুজোর আড়ংয়ে নিয়ে যেতেন। তেমন সুবিধামতো যানবাহন না থাকায়, জরাজীর্ণ কাঁচা রাস্তায় ভ্যানের ঝাকিতে গিলে-কলিজা এক না করতে চাইলে সারা রাস্তা হেটে যাওয়ার বিকল্প ছিলোনা। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বাবার আঙুল ধরেই হাটা শুরু হতো। কিছুক্ষণ পরেই বাবার আঙুল ঘেমে আমার হাতের মুঠো ভিজে যেতো। আমি হাত ছেড়ে দিতাম। ছুট পেয়ে বাবা চটচট করে হেটে খানিকটা দূর এগিয়ে যেতেন। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতেন। রাস্তায় তখন দূর্ঘটনার যমদের চলাচল ছিলোনা বললেই চলে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ধরে ফেলতাম। মনে হতো দৌড়ে ফাস্ট হয়ে গেছি। সাথেই সাথেই বাবার কাঁধে চড়ার আবদার করতাম। কি যে কষ্টের পথ! আমার বাবা কিন্তু তখন আমার বা আমাদের অনেকের মতো ইয়ং বাবা ছিলেন না। ছেলের আবদার রক্ষায় বাবা কপালের ঘামটুকু মুছে নিজের কাঁধ এগিয়ে দিতেন লক্ষণ দাস সার্কাসের হাতির মতো করে। আমি লাফ দিয়ে কাঁধে উঠে ঘোড়ায় সওয়ার করার আনন্দ পেতাম। আমাদের বাবাদের রোলগুলো কতোটা ত্যাগের, কতোটা কষ্টের আর কতোটা ধৈর্য্যের ছিলো! অথচ আধুনিক বাবারা কতোটা ভোগের, কতোটা সুখের আর কতোটা অধৈর্য্যের হয়ে গেছি। আজকাল সন্তানদের যে কোনো আবদারকে একটি ফোন, একটি আইপ্যাড বা একটি ল্যাপটপ ধরিয়ে দেবার মাধ্যমে খতম করে ফেলি! বাবার ঘামে ভেজা আধাপাকা চুল ধরে শক্ত করে বসে থাকতাম। আশপাশের হেটে যাওয়া ছেলে মেয়েদের বলতে চাইতাম দেখো আমার বাবা কতো ভালো, আমার বাবার কতো শক্তি! বাবার ঘামে ভেজা চুল ধরে রাখতে গিয়ে আমার হাত পিছলে যেতো। বার বার হাত বদল করে করে ঘামটুকু নিজের গায়ে মুছে নিতাম। আবার শক্ত করে চুল ধরে বসে থাকতাম। আনুমানিক মাইলখানেক একটানা হেটে চলতো আমার বাবা নামের ঘোড়াটি। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আবার হাটা, দৌড়ানো, কাঁধে চড়া এবং রক্তচোখা ঘট্টজীবীদের মাড়িয়ে শহরে পৌছাতাম। তারপর সেখানে অবস্থিত চাচার বাসায় গিয়ে আস্তানা গাড়তাম, যে আস্তানার স্মৃতি মিশে আছে প্রতিটি অর্জনে। যদিও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই কাঙ্খিত আড়ং এখন আর বসে না। সংস্কৃতিকে আধুনিক করতে গিয়ে পুতুলের পরিবর্তে মানুষের অশ্লীল নাচ, যাত্রাপালাকে অশ্লীল নৃত্যপালায় রূপান্তর এবং সার্কাসের নামে কি সব হাবিজাবি করে এটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। মেলার সেই ভডভডি গাড়ি, হরেক রকম বাশি, মাটির ব্যাংক, মাটির গরু, মাটির পুতুল, মাটির-হাড়ি পাতিল ছাড়াও কতোকিছু যে ছিলো! সেগুলো এখনো আছে, তবে আড়ংয়ে নয়।এই সংস্কৃতির অংশগুলো পড়ে আছে রাস্তায় ফুটপাতে যেখানে সেখানে অযত্নে অবহেলায়। এগুলো কিনতে বা দেখাতে সন্তানকে কাঁধে নিয়ে বাবাদের বারো মাইল হাটা লাগে না, সন্তানের মনে স্মৃতির বীজ বোপনের সুযোগও হয় না। বাবাদের কাঁধে না চড়া সন্তানেরা নিজের কাঁধে অন্যকে চড়ানোর মহত্ব কি করে বুঝবে! যাগগে সে সব কথা। আমার নরম কোমল চব্বিশ কেজি ওজনের মাহিব, যে নাকি নিজে এখনো একা একা ভাত খাওয়া শেখেনি। আজ তার দ্বারা চৌদ্দ কেজি ওজনের বোনকে কাঁধে নিয়ে এমন স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকাটা আমাকে বেশ অবাক করলো। মাঝে মাঝে যখন বাবা কাঁধে চড়ানোর শখ পুরণ করতেন না, আমার অবুঝ মনে তখন কি প্রতিক্রিয়া হতো জানিনা। হয়তো মনে মনে বলতাম আমিও একদিন কাঁধে করা শিখবো বাবা। তা না হলে তিনি নিজের কাঁধ ঝেড়ে ফেলে এতো আগে চলে যাবেন কেনো? নয়তো মাহিবের মতো তাকিয়ে থেকে আবার বাবার দিকে দৌড়াতাম। সবসময় মনে হয় বাবার দিকে এখনো দৌড়াচ্ছি, বাবার ঘামে ভেজা আঙুল ধরার খেলায় নিজেই নিজের প্রতিযোগী হয়ে। (লেখক : এম এম মাহবুব হাসান , ব্যাংকার)
BBS cable ad

সাহিত্য এর আরও খবর: