South east bank ad

খাজা খন্দকার এর ছোট গল্প: হেনরিয়েটা ও’র নাম

 প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারী ২০১৮, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সাহিত্য

খাজা খন্দকার এর ছোট গল্প:  হেনরিয়েটা ও’র নাম
হেনরিয়েটা ও’র নাম -----খাজা খন্দকার কার্তিকের সকাল, শেষ রাতের ছেঁড়া ছেঁড়া হাওয়ার মধ্যে শেখ পাড়ার সরল গ্রাম বাড়ি, গাছ-পালাও চুঁইয়ে মাঠের নতুন ফসল ঘিরে ফেলেছে হেমন্তের শান্ত শিশির। কয়দিনের বেড়ে ওঠা হাইব্রিডের সবুজ লক-লকে ধানের কচি পাতা ও সর্ষের হলুদ শরীর যেন কেড়ে নিচ্ছে ওপর থেকে নেমে আসা সূর্যের কিরণ। ভেজা মাটির বিচ্ছুরণে ভোরের কুসুম আলোটাও অন্যরূপ নিয়েছে। অপূর্ব এই দৃশ্যটায় বলে দিচ্ছিল আজকের দিনটি আমার জীবনে একটু অন্যরকম হবে। রোহিতা গোয়ালদা মাইদে পোলের হাট পার হলেই যশোর। প্রিয় গ্রাম পেছনে ফেলে আসার পথে পিচমাখা সড়কের দু’পাশে নগ্ন পুকুরে রাতের ক্লান্ত বধূদের স্নান দেখে আমার গায়েও কাঁটা দিয়ে উঠেছিল যেন ম্লান উষ্ণতা। ঠিক সেই অন্যরকম আবহ আবারো আমার শরীরে শিহরিত হল। মাকে ফেলে আসতেই মন চাইছিল না, স্বচ্ছ মাটির গায়ে বিজয়ের চিহ্ন আঁকা কৃষকরা বার বার পথ আটকেও দিচ্ছিল আমার। তবুও শেকড়ের টানটা ছিঁড়ে বাইকটা শব্দ তুলে ছুটে চললো যশোর পৌরসভায়। তখনো শহরের দোকান-পাট খুব বেশি খোলেনি, শুধু চোখের সামনে ভাসছিল ফেলে আসা আমার বাড়ির সামনের খোলা মাঠটা, মাইলকে মাইল কোয়াশায় মাখা সবুজ বৃক্ষরাজিগুলো। এই যে এখন ঢাকার বাসস্ট্যান্ডের সামনে হাওয়ার সঙ্গে খেলছে অসাধারণ মিষ্টি রোদ, এগারোটায় গাড়ি। চায়ের তৃষ্ণা আর সিগারেটের সঙ্গে সময়টা কাটানোর জন্য গিয়ে বসলাম টঙের দোকানের টুলটায়। এর মধ্যে একগাল বিড়ির ধোঁয়ার কু-ুলির মধ্যে ভলভোর কাউন্টারে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল, আর ঠিক চোখের পাতা পড়ার আগেই আঠারোশ’ আটষট্টির পয়লা আগস্টে ইংরেজ বাবুদের হাতে গড়া যশোর পৌরসভায় নামলেন তিন চাকার রিকশা থেকে মেম সাহেব, শুভ্র ভ্রু কুঁচকে চোখে চোখও রাখলেন আমার। ফের সকালের সেই অন্যরকম ভাবটার হাওয়া সেটা ভালোও আবার মন্দও হতে পারে স্পর্শ করলো আমায়। মোটকথা তখন খারাপ লাগলেও এখন আমার মনটা সত্যি ভালো হয়ে গেল। ঠিক যেন শাসক টিলম্যান হেংকেলের মতো, তাল লয় জানা না থাকলেও আমার রক্তেও নাচন উঠল মণিপুরি নৃত্য। দার্জিলিং, হাওড়ার পর যশোর, সেই পৌরের সভাপতি মি. মলোনীর উত্তরাধিকারী এই মেমই এখন আমার প্রিয়তমা। আমার নিঃশ্বাস আবার বিশ্বাস। খাজুরার পলেস্তারা খসা গোলাকার একতলা এই বাড়িটার নাম নিউ মার্কেট, আবার ভারতবর্ষের তৃতীয় পৌরসভার নামও যদি হয় যশোর। তবে সাদা মণির দীর্ঘাঙ্গিনী এই শ্বেত সুন্দরী মেমটির কী নাম দেওয়া যায়? পামেলা, অঞ্জেলিনা! শাকিরা! ক্যাটরিনা! সুফিয়া, রোজ না হয় হেনরিয়েটা! প্রথম পৌর পিতা হেংকেলে নামেই বলি শেষটায় যুৎসই, হেনরিয়েটাই ওর নাম। -এবার কাউন্টারের সামনে এগিয়ে এসে আগ বাড়িয়েই আমি বললাম হায়! -মরাল গৃবাটা উপরে তুলে হেনরিয়েটাও দ্বিতীয়বার আমার চোখে চোখ রেখে বলল হ্যালো! -আই ক্যাচেও তীব্র উষ্ণতা, সঙ্গে সঙ্গে শীত উপেক্ষা করে প্যান্টের পকেট থেকে সুইটারে ঢাকা হাতটা বাড়িয়ে আমিও বললাম আই অ্যাম জ্যাক। -মুখে কিছু না বলে মুক্তোর মতো দাঁত বের করে শুধু হাসলো ও। এখন কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না, নিজেকে থামাতে পকেট থেকে আরো একটা সিগারেট বের করে গুঁজে দিলাম ঠোঁটে। এ সময় বড্ড বোকা বোকা লাগছিল আমার। -আমার আনমনা ভাঙতে ওই বলে উঠল মি. জ্যাক। আমি অবাকও হলাম, আবার মুখ নামিয়ে দেখলামও ওকে। -আগের হাসিটায় ঠোঁটে ধরে শুদ্ধ বাংলায় ও বলল চুপ করে আছেন কেন? -আমি বেশি কিছু না বলে শুধু বললাম, না আজকের দিনটা বড্ড ভালো। -হেনরিয়েটা বললো, আপনি তো দেখছি বেশ রোমান্টিক! এ কথা শুনে মনে মনে বললাম তুমিও কম যাওনা, তবে শব্দ না করে আমিও হাসলাম। -তোমার হাসিটা খুব সুন্দর, হঠাৎ তুমি বলে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল হেনরিয়েটা। -জড়োতা কাটানোর জন্য এবার একটু সাহস নিয়ে আমিও বললাম, তোমার টাও। আবারো হাসলো ও, হেনরিয়েটার ধবধবে সাদা দাঁতের ওপর সূর্যের আলো আফ্রিকান ডাইম-ের মতো রঙধনু ছড়িয়ে পড়ল আমার রোদ চশমায়। -তোমার গন্তব্য কোথায়? -ঢাকায়, সাবলিল উত্তর দিল হেনরিয়েটা। -আমি বললাম বা, বেশ তো এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। -তুমিও আমার সঙ্গের যাত্রী! ভলভো এগারোটায় ছেড়ে যাবে এক সঙ্গে কথাগুলো বলে থামলো হেনরিয়েটা। -ইয়েস! আমি ওকে টিকেটটাও দেখালাম। -থ্যাঙ্কস বলে রিস্টওয়াচ দেখল হেনরিয়েটা, দশটা এখনো এক ঘণ্টা বাকি। ও বলল, চলো পাশের ওই মাটির পথ ধরে একটু হেঁটে বেড়াই। -আমি বললাম, এভাবে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই, তোমার ক্ষতিও তো করতে পারি। -ও চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আমি চিনেছি। -তুমি একটা পাগল, এতো অল্প সময়ে কাউকে কী চেনা যায়? তাছাড়া স্টেশন মানে খারাপ মানুষের স্থান। এখানে বিপদ পেছনে পেছনে ছোটে, একটু সাবধানে চলা ফেরা করতে হয়। -চেনার মন থাকলে প্রথম লুকিংয়ে তা যায়, আবার অনেকদিন একসঙ্গে থেকেও তা হয় না। আমি জানি বংলাদেশ, এ দেশের মানুষ ভালো। আরো বেশি ভালো জানি তুমি, চোখ বন্ধ করে তোমার কাছে নিজেকে তুলে দেয়া যায় বলে আমার কব্জি মুঠোবন্দি করলো নিজের হাতের মুঠোয় হেনরিয়েটা। -নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিকে যেতে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়? -ট্যারানাকি, নিউজিল্যান্ড। অবশ্য বাংলাদেশও বলতে পারো! -আমি একটু হেসে বললাম, ভারতবর্ষের তৃতীয় পৌরসভা যশোর বললে না কেন? -আমাকে খুশি করার জন্য ধরা হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হেনরিয়েটা বলল, শুধু যশোরই আমার দেশ। এ কথা শুনে আবারো গর্বে আমার বুকটা ভরে গেল, খুব ইচ্ছে হলো ওকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমো খাই। বিশ্বের সর্বোচ্চ দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশের কন্যার কথা শোন? যেন পবিত্র হরিণ শিশু, দুধমাখা শরীর নিয়ে খেলছে আমার সঙ্গে সাউথ আইল্যা-ের টিকাপো শহরের ধূমকেতুর বর্ণিল রূপ মেখে। ডেইরি খামারের লেকের জলে আলোর ছঁটা যেন উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপচে পড়ছে গ্রামময়, বালিকা আর ঘরে ফিরবে না, কোনদিন বলবেও না শেষ হও হে কৃষ্ণপক্ষ। আমাদের সামনে সানবাঁধা ঘাটে বসে জলে পা ছুড়ছিল বছর দশেকের একটা বালক, হেনরিয়েটা সে দিকে তাকিয়ে বলল, জান ছোটবেলায় আমিও জলে এভাবে পা ছুড়তাম, জ্বর আসবে বলে আমার দাদিমা বকুনি দিত, মা ছুটে এসে টাওয়াল দিয়ে গা মুছে আদর করে টেনে নিত বুকে। পৃথিবীতে দুটি জায়গা বড্ড নিরাপদ, মায়ের বুক আর প্রেমিকের কোলÑ বলে বাঁদিকে ঘাড় নামিয়ে দেখল আমাকে। -আমিও চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, হেনরিয়েটার গাল বেয়ে জল পড়ছে, ফের ইচ্ছে হলো ঠোঁট দিয়ে নোনা পানিটা চুষে নিই। -হেনরিয়েটা বলল, এখন আমার মা দাদিমা কী করছে, কেমন আছে জানি না। ধরা গলায় প্রার্থনা করল, আমার মতো ইশ্বর ওদেরকেও ভালো রেখো। -সঙ্গে সঙ্গে আমিও বললাম, হে ইশ্বর সব প্রাণীকে ভালো রেখো তুমি। -ইউ আর বুড্ডিস্ট! -নো, আই এম অ্যাবস্যুলেটলি মুসলিম। -চার পাশের প্রকৃতি উপোভোগ করতে করতে হেনরিয়েটা বলল, ইসলাম সর্ব শ্রেষ্ঠ আবার শান্তির ধর্মও, সব ধর্মের সহাবস্থান শুধু তোমরাই মানো। অথচ সহমর্মিতা মানবতার কথা বলে বিভিন্ন ধর্মের লড়াই দেখলে মনে হয় আদম-হাওয়া ছাড়াও মানবসৃষ্টিতে আরো কেউ আছে; কিন্তু সে কথাটি তারা বলতে ভয় পায়, কারণ সত্যি বলতে আর কেউ নেই। আমরা একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, তবে কেন অকারণে ধর্ম নিয়ে এতো গোলমাল। -হাত পা, চোখ কান মুখ, জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে ওঠা সবই একই নিয়মে হয়। তবুও জোর করে আলাদা করার চেষ্টা বলে থামলাম আমি। -মহা সড়কের পূর্বপাশে গভীর নলকূপে তোলা মিনারেল ওয়াটারে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা ছোট বোরো ধানের চারাগুলোর দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটা বলল, এই দৃশ্য দেখে আমার গ্রামের কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশের মতো আমার দেশও সবুজ আর খামারিও, এগ্রিকালচারে নিউজিল্যান্ড আর তোমার দেশের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। -আমি বললাম, মা মাটি ও দেশ সবার এক রকম। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদাও মেটে এসব থেকে। পৃথিবীর সব দেশই ন্যাচারাল এগ্রিকালচারালড্ । -চমৎকার বললে তো? -ওর মনের কথা জেনে ইচ্ছে করেই বললাম, মায়ের কথা মনে পড়ছে? -খুব, তবে অন্য মায়েদের দেখে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। -অন্য মা বলতে কী বলতে চাইছো? -হেনরিয়েটা বলল, ক’জন মায়ের কথা শুনবে। ধরো একজন বৃদ্ধ চারকূলে তার কেউ নেই, অভাব অনটন, দেহে নিঃশ্বাস আছে বলে বাঁচার জন্য সে লড়ছে, ঠিক যেন এসব মায়ের মতো, আমার মাও। -আমি বললাম, পুরো বাংলাদেশটা তুমি দেখেছো? -দেখেছিতো, আমি এনজিও কর্মী। -তোমার পা ছুঁয়ে একটু ছালাম করি! -ছিঃ জ্যাক! -আমি এ দেশের খাই-পরি, জন্মেছিও, সে দেশের হয়েও মানুষের সেবা করতে পারছি না, আর তুমি নিজের মাকে ফেলে নিউজিল্যান্ড থেকে এসে তাই করছ। এতে ছির কী আছে? -আছে বৈকী! আরে বোকা তুমি যে কাজ করছো সে কাজ হয়তো আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, সবাই চেরেটিতে সময় দিলে দেশকে এগিয়ে নেবে কে? তাছাড়া যে যা করছে সেটাও মানুষের সেবা, এখানে কোনো মায়ের উপকার করলে ওখানেও আমার মায়ের উপকারও কেউ না কেউ করবে, শুধু কাজের ধরনটা আলাদা। -যত কথাই বল আমার চাইতে তুমিই উত্তম। -এত বড় একটা সত্যি যখন উপলব্ধি করেছ, বুঝেছ তুমিও উত্তম বলে অনেকক্ষণবাদে হাসলো হেনরিয়েটা। -কতদিন ধরে আছো যশোর? -অনেকদিন। -তোমার জন্ম কী ঢাকায়? -না, যশোর মনিরামপুর শেখপাড়া গ্রাম। -এখানে কী মাকে দেখতে এসেছিলে! -হ্যাঁ, মাকে সঙ্গে গ্রাম ও ছোটবেলায় বেড়ে ওঠা মানুষ গুলোকেও। -কী করছো ওখানে? -ও’র কাজের কাছে আমার সাংবাদিকতার পেশাটা খুব বেশি বড় মনে হলো না, সেটা না বলে শুধু বল্লাম, চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। -অবশ্যই ভালো কিছু করবে, নিজের জন্য করলে তাতে অন্যেরও উপকার হয়। পৃথিবীর সবার উচিত নিজের জন্য করা, সমাজে যত মানি ফ্লো বাড়বে তত গরিব মানুষের কর্মসস্থান হবে, অভাব আর থাকবে না। -তুমি এখানে কোথায় থাকো? -ঝুমঝুমপুর। -ঢাকায় যাচ্ছ কেন? -মিরপুর, হেড অফিসে যাচ্ছি প্রোজেক্টের কাজে। -পুর আর পুর বেশ মিল আছে, মনিরামপুর ঝুমঝুমপুর আবার মিরপুর তাই না! -ঢাকায় তোমার বাসা কোথায়? -রমনা, মগবাজার। -ওই জায়গাটার নাম মগবাজার হলো কেন? -এক সময় মগদের বসবাস ছিল তো তাই। -এখন নেই এইতো! সব দেশেই উপজাতিরা বড্ড অবহেলিত! -সত্যি বলেছ, ক’দিন আগে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে মণিপুরিদের দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে। একই মানুষ অথচ জাতিগত বিভেদ দেখলে আর কিছু ভালো লাগে না। -হেনরিয়েটা বললো, সুবিধাভোগী একটা চক্র জাত-পাতের বেড়াজালে মানুষকে আলাদা করে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলেছে। -তোমাদের বেশ সুবিধে, খুব কাছ থেকে মানুষের অসুবিধাগুলো দেখতে পাও, বিভিন্ন ফোরামে তা তুলে এনে সমাধানও করো। এতে সামাজিক ভারসাম্যও রক্ষা হয়, না হয় অধিকার বঞ্চিতদের বিদ্রোহের মুখে উঁচু তলার মানুষদের স্ট্যাটাস নষ্ট হতো। -আত্ম-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে খানিকটা সচেতনতা আছে তোমার মধ্যে। -ডিপ্রাইপ যারা তদের মধ্যে এটা থাকে, কিন্তু প্লাটফর্মের অভাবে তা প্রকাশ পায় না। তা অবশ্য ঠিক। প্রাসঙ্গিক গল্পে গল্পে আমরা একটা বাঁশ ঝাড়ের নিচে এসে দাঁড়ালাম, তখন রোদের ঝাঁঝমাখা মিষ্টি হাওয়ায় বাঁশের কচি পাতাগুলো যেন ভায়োলিনের সুরে বেজে চলেছে। সকালের তাঁতানো সূর্যের সঙ্গে অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ছায়ায় এসে গা থেকে পুল-ওভারটা খুলতে খুলতে হেনরিয়েটা আবৃত্তির ঢঙ্গে গেয়ে উঠল ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শ্লোক বলার কাজলা দিদি কই’। ওর মুখে পল্লী কবি জসীমউদ্্দীনের কবিতা শুনে বিস্মিত, আভির্ভূত। খুব সাহসের সঙ্গে এই প্রথম দুই হাত বাড়িয়ে আমার বুকে টেনে নিলাম হেনরিয়েটাকে, ক্ষেত-খামারের মেহনতি মানুষ, ডানে-বাঁয়ে হেঁটে চলা পথচারীদের তাকানোয় ভ্রƒক্ষেপ না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেনরিয়েটাও পাল্টা জবাব দিয়েছে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে। -ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই, আমি হেনরিয়েটার গ্রিবাই নাক ঘষতে ঘষতে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ফিস ফিস করে বললাম, এখনই আমাদের বাস যশোর ছেড়ে চলে যাবে। সময় সচেতন হেনরিয়েটাও সাহেবী কায়দায় আমার হাত ধরেই দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল খাজুরা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। এ সময় স্পষ্ট শুনলাম যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিৎকার দিচ্ছিল অতি আরামদায়ক এই বাসটির সম্মানিত সুপারভাইজার। তের নম্বর কোচটি এখনই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে, দয়া করে আপনারা যে যার আসন গ্রহণ করুন। অন্যদের মতো আমরাও গিয়ে বসলাম সিটে। মৃদু শব্দ তুলে দুলে উঠল ভলভো। স্টেয়ারিংয়ে বসা পাইলট দু’বার ভেঁপু বাজিয়ে ক্লোজ করলেন ডোর, কাটায় কাটায় এগারোটায় গাবতলীমুখী ভলভো ছেড়ে গেল যশোর নিউমার্কেট। প্লাস্টিকের ফিতেই মোড়ানো উইন্ডোর পর্দাটা ছেড়ে এবার হেনরিয়েটা আমার মাথাটা টেনে নিল কোলে। এয়ারকুলারের হাওয়ায় সোনালি চুলগুলো একাই ঢেউ খেলছিল আমার নাক-কান-মুখ বেয়ে, বাদামি আঙুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিল সাবলীল ঠোঁট। ওর কোলে মাথা রেখে আমি কাঁপছিলাম আলোর বুক চিরে দুলে দুলে মাগুরার দিকে এগিয়ে চলা ভলভোটার মতো। মুখে কিছু না বলে আমি শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম হেনরিয়েটার দিকে, বিদেশি হয়েও এতটা মমোতাময়ী যে কেমরেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম অঙ্গে মাখা মাটির সঙ্গেও। এক আকাশ, এক মাটি, নিখুঁত ভালোবাসায় একবিশ্ব এক পরিবারও অথচ, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সবার ভূমিতে সীমারেখা আছে। মাটিতে প্রাচির দিলেও আকাশটা কেউ এখনো আলাদা করতে পারেনি, পারেনি ধর্মে ধর্মে গড়ে ওঠা মনের সম্পর্কটাও তারকাঁটা দিয়ে আটকাতে। এই মাত্র সীমাখালী পার হলো কোচটা, আগের মতোই আছে হেনরিয়েটার খেলাটাও। কোল্ড হাওয়া তবুও ওর হাঁটু ভাঙ্গা কোলে আমি ভিজে যাচ্ছি ভালোলাগায়, অন্যরকম আবেগি কতকিছু ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে ক্ষণে ক্ষণে মনটাও ভালো হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আর মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা মাগুরায় পৌঁছে যাব, সবুজ উদ্যানে ঢাকা আড়পাড়ার বুক ধরে এক তালে এগোচ্ছে ভলভো। এ সময় প্রকৃতি তার নিজেস্ব নিয়মে বইছিল, ঝোঁপ-ঝাড়ের ওপর দিয়ে ছন্দায়িতভাবে উড়ে যাচ্ছিল গাংচিল, শালিক, ঘুঘু খয়েরি রঙের মাছরাঙাগুলোও। কিচ্ছুক্ষণ পরপর জানালার পর্দা সরিয়ে হেনরিয়েটা দেখছিল এসব মনমুগ্ধ দৃশ্যাবলি, সঙ্গে শিশুদের মতো আনন্দও প্রকাশ করছিল শব্দ করে। মহান সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষের জন্য স্বর্গ অথবা নরক উপহার দেন, তবে ধরে নেব আমি সত্যিই স্বর্গে আছি। এত দুর্যোগ আর অশান্তির মধ্যেও। এ জন্য মহাশক্তির প্রতি গভীর কৃজ্ঞতা জানালাম। ’সিন অ্যান্ড প্রোফিট’ আসলে তিনি এপারেই রেখেছেন। হেনরিয়েটার গায়ের মিষ্টি গন্ধ এত ভালো লাগছে যে, ইচ্ছে হচ্ছিল বাস থেকে নেমে যাই, ও’কে নিয়ে হারিয়ে যাই গভীর জঙ্গলে। আমার সামনে ভেসে উঠল সকালটা, শুরুতেই যা ভেবেছিলাম দিনটাও ভালো। মায়ের কথা, গ্রামের কথা, একই রক্তে মাংসে গড়া খামারি ভাইদের কথাও মনে হলো। আমি নিটোল অপ্সরীর কোলে মাথা রেখে যে আনন্দ করছি, পালাতে চাইছি। আন্যরা যে যার কাজেও আনন্দ করছে, পরিসমাপ্তিও চাইছে চূড়ান্ত বিজয়ের। -অনেক্ষনবাদে হেনরিয়েটা বলল, খামারের জন্য বিউটিফুল জোন যশোর। -আমারও তাই মনে হয়, তবে পুরো দেশটাই সোনার মাটি। -কি ভেবে হেনরিয়েটা আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল, এখানে তুমি আমাকে এক হাজার একর জমি দাও। আমি তোমাদের সব দেব, ‘আই মিন’ যশোর জেলার মানুষকে কারো কাছে আর কিছু চাইতে হবে না। বরঞ্চ অন্য জেলাকে দিতে পারবে। -এ কথা শুনে আমি তন্ময় হয়ে দেখছিলাম রোমান্টিক আর প্র্যাক্টিক্যাল হেনরিয়েটার মধ্যের তফাতটা। ওরা ভালোবাসার মধ্যে মানুষ ও দেশকেও টানে। -জানো! বাংলাদেশের মানুষ এতো ভালো যে, নিপীড়ন অনাচারের মধ্যেও দিব্বি -বেঁচে আছে, ‘ইউ আর সো মাস জিনিয়াস’ তারা লড়াইটার কায়দাটাও ভালো জানে। -আমি বল্লাম, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সাহসি ও পরিশ্রমি জাতি। তুমি না বলেছিলে সোনার মাটি, ‘অ্যাবসুলেটলি রাইট আফটার অল গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান। তার নির্দেশে আমরা তো অস্ত্র ধরে দেশ স্বাধীন করেছি। আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, বাবার মত অসংখ্য মানুষ জীবন দিয়েছে। -আই নো, তিনি ‘ফাদার অব নেশন’ এ কথা বলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে হেনরিয়েটা বললো, তুমি শহীদ পরিবারের সন্তান তোমার সাথে দেখা হলো এ জন্য আমি ধন্য, আমার ভীষন ভালো লাগছে। তোমরা বিরের জাতি, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছো সত্যি জন্ম আমার ধন্য হলো। -আনন্দে আমার বুকটা ভোরে গেল, তবে তা প্রকাশ করলঅম না। একটু কঠিন হলেও সঙ্গে সঙ্গে হেনরিয়েটা বললো, অ্যাজ গুড, ব্যাপক সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, তবে যারা নয় মাসে দেশ স্বাধীন করতে পারে। তাদের চল্লিশ বছরেরও বেঁচে থাকার জন্য হাত পাততে হয় অন্য দেশে ‘ইট সে নট গুড ম্যাসেজ বাট হোয়াই’? এবার থামলো সে। -মুখে কিছু বল্লাম না, মনে মনে ভাবছি কেমরেই যেন আমি ধরা পড়ে যাচ্ছি, মনের সঙ্গে প্রাণটাও বুঝি এখন যায়। ওর এই ফিলিংসটা আমাকে এতটাই ছোট করে দিল যে, ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে এই শ্রেষ্ঠ নারীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এর একটা যুৎসই জবাব চাই? আমাদের নিয়ে হেনরিয়েটার এ ভাবনায় মুখে কিছু না বলে শুধু অন্তর থেকে শুভ কামনা করলাম ওর। -হেনরিয়েটা ফের বললো, বাঙালিদের মধ্যে ¯িপ্রট আছে, শুধু সূত্রটা ধরিয়ে দেয়ার দরকার। একদিন অবশ্যই জাগবে এ দেশ, আর তা জাগাতে হবে এ প্রজন্মকে। -এবার আম বল্লাম, এক হাজার একর জমি থাকলে তুমি কি করতে? -তোমাকে বিয়ে করতাম! আর কিছু না বলে দু’গালে ভাঁজ ফেলে হাসলো হেনরিয়েটা। -চোখে মুখে ফুটে ওঠা কষ্টের ছাপটা লুকিয়ে বললাম ও আচ্ছা? -আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কি মনে করে হেনরিয়েটাও শুধু বলল, বুদ্ধু। -আমি সরে যাওয়া পর্দার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখলাম, নিখুঁত এক খ- কালো মেঘ সাদার মধ্যে ঢেকে গেল চোখের পলকে। খানিটা সময় চুপচাপ, এখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আসলেই কি এক হাজার একর জমির উৎপাদন দিয়ে এক জেলা মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব? এমন কি জাদু আছে হেনরিয়েটার হাতে! সেই জাদুর কথা কি জানে না কৃষি মন্ত্রণালয়? জেলা লেভেলের কর্মকর্তারা কি অকর্ম! মানুষের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটে মাটি থেকে, ন্যাচারাল শক্তির উৎসও ভূমির রস। আমাকে জানতেই হবে, কিছু না করতে পারলে একটা খামার করে নিজের সঙ্গে দশজনের উপকারও তো করতে পারব। -কী ভাবছো জ্যাক? -ফের সুযোগ পেয়ে বললাম, এক হাজার একর জমি দিয়ে তুমি কি করতে চাও? -চমৎকার প্রশ্ন, সেখানে সব কিছু উৎপাদন হবে। শুরু হবে গরু দিয়ে, মাংস-দুধ। বর্জ্য, গ্যাস বিদ্যুৎ সার, ফ্রেশ ওয়াটার। খাদ্য ফল সবজিসহ পরিবেশ রক্ষায় থাকবে বৃক্ষরাজিও। ধরো সয়েল টেস্টের রিপোর্টেই সব উৎপাদনই হবে নাগরিক প্রয়োজনে। -এক্সিলেন্ট আইডিয়া? -শিল্প-কলকারখানার পাশাপাশি কৃষিতেও বিনিয়োগ হওয়া দরকার, উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের এগিয়ে আসতে হাবে। বিদেশ বিভুঁয়ের নামে পাঁচ, ছয়, আট লাখ টাকা খরচ করে সমুদ্রের জলে ডুবে মরার চাইতে ছোট খামার গড়ে উন্নত জীবন উপভোগ করা যায়। বাংলাদেশের মাটিও অন–কূল বলে কি যেন ভাবছে হেনরিয়েটা। আমাদের অবস্থানটাও এককালের যশোর, গাড়িটা মাগুরা ছুঁই ছুঁই করলেও আগে এ অঞ্চল যশোরেরই অংশ ছিল। বাংলাদেশের প্রথম পৌর গঠনে বিটিশদেরও পছন্দ ছিল যশোর, সত্যি বলতে খামারিতেও বিদেশি মেমের প্রথম পছন্দ এই যশোর। ইতিহাসসমৃদ্ধ বড় এই শহরের নামকরণ নিয়েও বেশ জৌলসতা আছে, গৌঢ়ের ধন যশ হরনের মাধ্যমে শ্রীবৃদ্ধির পর ফরাসি শব্দ জসর থেকেও যশোরের উৎপত্তি। যাই হোক যশ ও জসর মিলে বড্ড আর্থবহ এই যশোর। লাট হেংকেলের মতো হেনরিয়েটাও সেই যশোরের সঙ্গে আমাকে বেছে নিয়েছে। সকালটাও খুব আনন্দ এনে দিয়েছে সামনে, নিচে নামতে নামতে গভীরে চলে যাচ্ছি। আমার গ্রামের মিষ্টি বুনো জঙ্গলের আড়ালে উন্মাদের মতো বিচরণ করছি হেনরিয়েটার নগ্ন সরু কোমর বেয়ে নিতম্ব অবদি। ধানের শরীর থেকে চাষির আগাছা ছাড়ানোর মতো আমার পাঁচ আঙুল ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর উন্মুক্ত মৃগম-ল, কখনো-সখনো টিকালো নাক, লালাই ভেজা ঠোঁটও। হায় আল্লাহ! একটা চলন্ত বাসের মধ্যে আমি শুয়ে আছি হেনরিয়েটা কোলে, এখন দেখছি চোখ নাক ঠোঁটশুদ্ধ আমার মুখটা তলপেটে গোঁজা থাকলেও আমার হাত দুটো স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে আছে হালকা সোনালি আবহ হেনরিয়েটার বাহু। উষ্ণ তালুতে আমার মুখটা তুলে ঠোঁটে চুমো খেল হেনরিয়েটা, একটু বেশি ঝুঁকে পড়ায় স্তনবৃন্তের মৃদু কম্পনও উঠল আমার কালো মণিজুড়ে। বন্ধ চোখে আরো অন্ধকার নামিয়ে দিল কাচুলিবীহিন স্তনযুগল। আবারো মনে পড়ল সকালটা, আড়ালটাও এলো সামনে। শির শির করে উঠল গজদাঁত, শ্বাসও ছোট, শরীরে চঞ্চলতা টের পেয়ে -আমার প্রিয়তমা মেম সাহেব বলে উঠল, এই! দেখো কি সুন্দর সাদা মেঘ উড়ছে। -চার দেয়ালের মাঝে কোথাও হবে, মুখ না তুলেই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, আহা! কথা বলো না তো? -তোমার কা-টা কাব্যিক? এই নদীটা মৃত কেন? -চোখ না খুলে বললাম, গড়াই, বেশি গড়াগড়ি খেতে খেতে ধুলো জমেছে গায়ে। দেখছো না ব্রিজটাও ঢেকে গেছে ডালপালায়। শুধু কবিতায় আছে নদীটার নাম। -প্রথম যখন বলেছিলে আজকের সকালটা চমৎকার, ভেবেছিলাম কবি। দিনটা ভালোবাসার, কবিতা পড়ার, মানুষকেও ...। -চিৎকার করে উঠল হেনরিয়েটা, গ্রেট সঙ! কার যেন, ওহ ভুপেন। আমি ভলোবাসি তোমাকে, তুমি ভালোবাসো আমাকে, এসো দু’জনের সব ভালোবাসা আজ বিলিয়ে দিই এই দেশটাকে। -সত্যি এখন কান্না পাচ্ছে, প্রিয় দেশ আমার বাবার রক্তে রাঙানো মাটি বাদ দিয়ে হেনরিয়েটার হাত ধরে পা ফেলবো কোথায়? স্বর্গের মধ্যে তাকালাম, পাতার ওপরে আটকেপড়া গোলাকার জলের ফোঁটা উপচে পড়ার আগেই মুছে দিলাম আঙুল দিয়ে। -হেনরিয়েটা বলল, কাব্যময় উজ্জীবতা, তুমি হেলাল হাফিজের কবিতা পড়েছ? -কোনটা, ‘ভালোবাসবো একশ’ বছর!’ -না, এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। -এই কবিতাটা মনে হয় শুধু তোমার জন্য। -উদ্বুদ্ধকরণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কবিতা। তরুণ তরুণীদের জন্যও, আবার প্রগতি সংহতির জন্যও। মানবতার আবেদনও আছে যথেষ্ট। মেয়েটাকে ভালোবাসবো না পুজো দেব? বিস্ময়করও বটে। শুধু দেহের জন্য শরীরটাই আসল নয়, দেশ আর মানুষ নিয়েই জীবন। সে জীবনের একটা পাটই সুখ। সব কিছু তুচ্ছ করে হেনরিয়েটা সেই দেশ আর মানুষকে নিয়েই সুখের স্বপ্ন দেখছে আমি কেন তাকে আটকাতে চাইছি? -কেউ দেখছে না অথচ পরাজয়টা আমাকে স্পর্শও করছে কষ্টের হল্কায়। -হেনরিয়েটা বলল, জীবনের ভালো দিনগুলো গুনে ফেলা যায়। অবশ্যই তার মধ্যে আজকেরটাও। যদি জানতাম তুমি আসবে বেলি ফুলের মালা পরে আসতাম খোঁপায়। -নিশ্চিৎ বাঙালি রমণী, এই তো! -বাঙালি বাবুর ঘরণী অবাঙালি হবে? তাছাড়া নারী আবার বাংলা, ইংরেজি, আরবি আছে নাকি! -সত্যি তুমি খুব ভালো। -বেঁচে থাকার জন্য মেয়েদের ভালো থাকতে হয়। -মানে? -মেয়ে আর মায়ের মধ্যে খুব বেশি মিল তো তাই। মধুখালীর মোড়, থেমে গেলো বাসটা সঙ্গে ছুটে আসা প্রকৃতিটাও। শীতের বিকেল কুলারের হাওয়ার মধ্যে এ কথা শুনে বেশ উষ্ণতা পেলাম মনে। আকাশের গায়ে স্থির চাঁদটার মতো এতক্ষণ বাইরের দৃশ্যগুলোও যেন চলন্ত গাড়ির সঙ্গেই চলছিল, যেভাবে আমিও ধরেছিলাম হেনরিয়েটাকে। আবারো মৃদু কেঁপে উঠল বাসটা, মনে হলো একই আকাশ একই দৃশ্য, যেমন হেনরিয়েটাও আমার এটাই সত্যি। তাহলে নারী-পুরুষের মধ্যে ভালো মন্দের তফাতটা কোথায়? তা আমার মাথায় এলো না। বুঝা যায় না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটা চলছে না থেমে আছে, যেন ভালো লাগা অপরিসমাপ্তির মতো। কখন যে বাসটা শেকড় গেড়ে বসেছে তা টের পেলাম এই মাত্র। হাফ কিলো হবে গোয়ালানন্দ ঘাট, যানজটটা নিয়মিত হওয়ায় রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন খাদ্যের দোকান। যাত্রীদের অনেকেই খাদ্য গ্রহণ, জলজ বিয়োগে নেমে গেল, কেউ এখনো ঘুমের কোলে ঢোলেও আছে। -হেনরিয়েটা বলল, আন-হাইজেনিক খাদ্য, কি পরিমাণ ধুলো উড়ছে দেখেছ? -ওই নরকের চাইতে আমাদের এ স্বর্গ অনেক ভালো। -প্রশাসনের লোকেরা কিছু বলে না! -ভেজালই হাইজেনিক, নির্ভেজালই আন-হাইজেনিক! -ও আচ্ছা বলে কোলের ওপর থেকে আমার মাথাটা তুলে নিলো বুকে। -আমিও কিছু না বলে শুধু শপে দিলাম নিজেকে। হাঁসের মতো বাঁক নিচ্ছিল ‘ইনায়েতপুরী’ পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরে লম্বা পা ফেলে লাফাচ্ছিল একটা সাদা বক। -আমাকে নিয়ে হেনরিয়েটা পাটাতনে নেমে বলল, ইনায়েতপুরী একজন মহামণীষীর নাম ধারণ করে আছে ফেরিটা। হাঁস না বলে এটাকে ছোট-খাটো বাংলো বলাই ভালো, খাওয়া ঘুমোনো এমনকি নাবিকদের স্নানের জায়গাও সংরক্ষিত। ফেরিতে ওঠা গাড়ি থেকে অনেক যাত্রী নেমে ক্ষেতে বসলো, আমরাও খেলাম পঞ্চাশ টাকায় ইলিশ আর ডাল-ভাত। -ইলিশ মাছের কাঁটা বাচতে বাচতে হেনরিয়েটা আরো বলল, হাওয়ার সঙ্গে জল ও ঢেউয়ের মাখামাখিতে হাইজেনিক আন-হাইজেনিকের প্রশ্ন নেই। ইলিশ আর পদ্মার জল আমি তৃপ্তি নিয়ে খাই। -ওর একটু আগের কথাটা মনে করে হাসলাম আমি। পাটুরিয়া ঘাট দেখা যাচ্ছে, ফের গিয়ে বসলাম সিটে। আগের মতোই মাথা হাত স্থাপিত হলো একই জায়গায়, বন্ধনটা সকাল এগারোটা না তারও আগে যেদিন দুটো জীবন শুরু হয়েছিল? এই পৃথিবীতে আমরা এসেছি সত্যিই, চোখেও দেখছি ঠোঁট নেড়ে কথাও বলছি। কান দিয়ে শুনছি, নাক দিয়ে হেনরিয়েটার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণও পাচ্ছি। এ জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম, সৃষ্টির সব রহস্য মনে করলে কারো পক্ষে অপরাধ করা সম্ভব নয়। অসাধারণ প্রকৃতি, যার যা প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তা তাকে তা দিয়েছেন। নির্মাণ ভাঙন সবই তার ইশারায়, অনিয়ন্ত্রিত নিমগ্নতায় আমিও বেড়ে উঠছি হেনরিয়েটার হাতে হাত রেখে। সেও বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে আমাকেও ভেবেছে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ। শিবালয়, মানিকগঞ্জ, নবীনগর, সাভার পেছনে। সময়ের কথা ভাবলে জায়গাটা গাবতলীই ছিল, এইমাত্র কলেজ গেট স্পর্শ করল বাসটা। -আমার শরীরটা টেনে তুলে বসিয়ে দিল সিটের ওপর, এরপর হেনরিয়েটা বলল, পরে দেখা হবে, আই লাভ ইউ বাংলাদেশ, আই লাভ ইউ টু। -এ কথা শুনে কিছু বলতে পারলাম না, শুধু দেখলাম শেষ বিকেলের সূর্যটা ডুবে যাওয়ার মতো জনস্রোতে হারিয়ে গেল হেনরিয়েটাও। এইমাত্র আমার চোখে জল এলো হারানোর, আবার প্রিয় দেশকে ভালোবাসায়ও।
BBS cable ad

সাহিত্য এর আরও খবর: