বইমেলায় মাসরুর আরেফিন এর ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘ ও ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে‘

বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন। ব্যাংকার পরিচয়ের পাশাপাশি সমকালীন বাংলা সাহিত্যে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা মাসরুর আরেফিন মূলত কবি। তাঁর জন্ম ১৯৬৯ সালে বরিশাল জেলায়। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য এবং মার্কেটিং ও ফিন্যান্স-এ। ২০০১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প প্রকাশের পর তা বাংলা কবিতার পাঠককে দিয়েছিল নতুন কাব্যভাষার স্বাদ। বইটি সে বছর প্রথম আলোর নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর মৌলিক সাহিত্য রচনা থেকে দীর্ঘ একটা বিরতি নিয়ে তিনি ডুব দেন বিশ্বসাহিত্য অনুবাদের কাজে। অনুবাদ সাহিত্যেও মাসরুর আরেফিনের অবদান বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর অনুবাদে ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র (২০১৩) ব্র্যাক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি-চিত্তরঞ্জন সাহা সেরা প্রকাশনা পুরস্কার লাভ করে। ২০১৫ সালে বেরোয় তাঁর হোমারের ইলিয়াড এবং সমাদৃত হয় পাঠক মহলে। এরপর ২০২০-এ তিনি আবার ফিরেছেন কবিতায়। কথাসাহিত্য আর কবিতা লিখে চলেছেন দুহাতে। গত বইমেলায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়-এর পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস আলথুসার এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প’র পরিমার্জিত সংস্করণ।
এবছর বইমেলায় আসছে মাসরুর আরেফিন এর উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘ ও কাব্যগ্রন্থ ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে‘।
এ সম্পর্কে মাসরুর আরেফিন তার ফেসবুকে লিখেন;-
প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’-য় মাসরুর আরেফিন ঘুরে এসেছেন সভ্যতা নির্মাণ-প্রজেক্টের মাস্টারপ্ল্যান—দেখতে যে, সেই নির্মাণ কাজে কীভাবে পাথর বারবার ছোড়া হয়েছে পাখির দিকেই, নির্বিচারে, এবং এই নিধনের মহাকাব্যিক প্রক্রিয়াটা সত্যি কী?
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার‘-এ তিনি বুঝতে চেয়েছেন রাষ্ট্রের চাকা কীভাবে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ঘোরে আর মনুষ্যের পেটে ভাত তুলে দেবার স্বার্থে বলি দেয় গাছ-মাটি-নদী-নক্ষত্র ও ভোরের হাওয়াকে।
আর তৃতীয় এ উপন্যাসে তিনি জানতে চাইছেন রাষ্ট্রের নৈতিক ও মানসিক পরিকাঠামোটিকে, যা এমন এক সিস্টেম গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর যেখানে সবকিছু ‘ওভারগ্রাউন্ড‘ ও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘-এর মধ্যে ভাগ ভাগ—অগ্রগতির বায়োস্কোপ উপরে, আর নিচে আতঙ্ক ছড়ানোর ‘প্রজেক্ট-কালাকানুন‘, একটা আরেকটার আবার পরিপূরক।
বাস্তববাদীরা বলেন, নির্দিষ্ট ওই একভাবে ‘সিস্টেম’-টা চলে বলেই টিকে আছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু কী সেই ‘সিস্টেম’ যার আছে শুধু ভয়জাগানো এক শারীরিক বাস্তবতা? আর তাই যা কিনা রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে মন ও মননের আধ্যাত্মিক জায়গাটুকুতে নিঃস্ব ও খোজা করে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?
এখানে ছাব্বিশ বছর পরে এক ভাই তার হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইকে খুঁজছে দূর এক দেশের লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এই কালে; দুই বন্ধু হিসাব মেলাতে চাইছে শৈশবের বরিশালে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর এক অন্যায়ের সঙ্গে পরের এক নৃশংস সাম্প্রদায়িক খুনের; আর নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক লোককে তারই স্বদেশী ধনী বড় ভাই সাহায্য করতে রাজি কেবল ওই নিঃস্ব মানুষটার স্ত্রীকে বিছানায় নিতে পারার শর্তেই। সেইসঙ্গে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলশতামের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহরণকারী হত্যাকাণ্ড যত তার জট খুলছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে যে কেন লেখকের ক্ষমতা রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীতমুখীভাবে ক্রিয়াশীল।
মান্দেলশতাম বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা তুমি ততটাই জঘন্য, যতখানি নাপিতের আঠা-আঠা আঙুলগুলি।’ এই ভাষার জন্যই কি জীবন দিতে হল তাকে? লেখক-কবি-শিল্পীরা কি শাসকের সঙ্গে চিরকাল ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে শাসকের চেয়ে তার ভাষা ও মানসিকতা দৃঢ়তর বলেই? এমন কি যে, তারা আন্ডারগ্রাউন্ডের সত্যকে বোঝেন বলেই ওপরের পরিস্থিতির রাজনৈতিক সত্যটুকু তাদের কাছে তামাশা বা ইয়ারকি মাত্র?
ওভারগ্রাউন্ডে কি তাহলে কোনো ‘সত্য’ নেই? শেষ বিচারে ‘সত্য’ আছে কি কেবল আন্ডারগ্রাউন্ডে, যেহেতু ওখান থেকেই প্রসেস করা হয় মাটির ওপরের মৃত্যুগুলি? আর বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র যে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তি আরও শক্তিহীন, সেটাও কি কেউ নিশ্চিত করে দেয় ওই আন্ডারগ্রাউন্ডে বসেই?
উপন্যাসে আন্ডারগ্রাউন্ডের কালো প্রান্তরে নায়কের সঙ্গে দেখা হয় সাক্ষাৎ শয়তানের। যে-মুহূর্তে নায়ক বুঝতে পারে শয়তান, নরঘাতক ও জাঙ্গিয়া-পরে-নাচা নীতিনির্ধারকদের দেখবার জন্য নরকের ওই দিকটায় যাবার আসলে দরকারই নেই, শয়তান তখুনি তাকে বলে দেয়: ‘রোসনলাল, নরঘাতক, গেট আউট ফরোম দিস উন্টারগ্রুন্ড।’