"স্বাধীনতাত্তোর চট্টগ্রামের নাট্যান্দোলন এবং সদরুল পাশা"

কাজল সেন
স্বাধীনতা পরবর্তী নানা সংকট ও সমস্যাসংকুল বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে নাট্যচর্চা অব্যাহত রাখা খুব সহজ কাজ ছিলনা। তার মধ্যেও যাঁরা নানা বাঁধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে নাট্যচর্চায় নিবেদিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সদরুল পাশা। স্বাধীনতাত্তোর চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন তিনি। সে সময় চট্টগ্রামে যে কজন সংঘবদ্ধ থিয়েটারের সূচনা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সদরুল পাশা। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সময়কালে চট্টগ্রামের মঞ্চ নাটকের তিনি ছিলেন প্রাণ পুরুষ। তাঁর অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিনয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের থিয়েটারকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে একজন নিবেদিত প্রাণ শিল্পী।
সদরুল পাশার জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ মা সেলিনা রহমান ও রাজনীতিবিদ পিতা ডাঃ এ বি এম ফয়েজুর রহমানের প্রথম সন্তান। বাবা ডাঃ এ বি এম ফয়েজুর রহমান ১৯৭০ এর নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মেধাবী সদরুলের বেড়ে ওঠা এ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে, চট্টগ্রাম শহরের আলো বাতাসেই। দারুণ মেধাবী সদরুল বড় হয়ে ডাক্তার হবে, এ ছিল পরিবারের সকলের আশা। সে অনুযায়ীই সবকিছু চলছিল। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এরপর চট্টগ্রাম কলেজ এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ডাক্তার হওয়ার আশায়। কিন্তু সদরুল ছিলেন অনেকটা খেয়ালী, আবেগপূর্ণ ও মুক্ত হৃদয়ের একজন মানুষ। তাই বৈষয়িক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর আবেগি সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, সমাজ বাস্তবতায় অনেকটা নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পেশার লেখাপড়া মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ২য় বর্ষে পড়াকালীন অবস্থায় সবাইকে অনেকটা অবাক করে দিয়ে ডাক্তারী পড়া বাদ দিয়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলে যান চলচ্চিত্র বিষয়ক পড়াশুনার জন্য। তাঁর এ যাওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তারপরও তিনি গেলেন। সে যাওয়াতে আর কখনো কিন্তু পুরোপুরিভাবে ফেরা হয়নি এই চট্টগ্রামে।
স্কুল জীবন থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিংবা ক্যাডেট কোরের নেতৃত্ব দানের গুণাবলী সম্পন্ন সদরুলের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে। ঐ সময় কলেজে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সদরুল আবির্ভূত হলেন নাট্যকর্মী অভিনেতা সদরুল হিসেবে। পরবর্তীতে নাটকের প্রতি প্রবল আবেগ আর ভালোবাসা থেকে তিনিসহ কয়েকজনের প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা লাভ করে চট্টগ্রামের প্রথম থিয়েটার দল “থিয়েটার” ৭৩। যার মাধ্যমে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সূচনা আর তার অন্যতম সফল সংগঠক অভিনেতা সদরুল পাশা। এ সূচনা পর্বে চট্টগ্রামে নানা সংকটকূল পরিস্থিতিতে সদরুল তাঁর দুর্দান্ত সাহসী নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করার মধ্য দিয়ে ঐ সংকটময় পথ অতিক্রম করেছিলেন। অবশ্য এ নব নাট্য আন্দোলনে তিনি উপদেশক ও আশীর্বাদক হিসেবে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমেদ ও নাট্যজন অধ্যাপক জিয়া হায়দার এর মত নাট্য ব্যক্তিবর্গকে।
এ সময় ‘থিয়েটার’ ৭৩ থেকে একে একে ‘ম্যাসাকার’, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, ফলাফল নিম্নচাপ প্রভৃতি মঞ্চস্থ হতে থাকল। আর সূচনা পর্বে মঞ্চস্থ উক্ত নাটকগুলোর প্রায় প্রতিটির প্রধান চরিত্রে অভিনেতা সদরুল পাশা। চারিদিকে তখন তাঁর জয়জয়কার।
কিন্তু এর মধ্যেও বছর ঘুরতেই নানা কারণে থিয়েটার’ ৭৩ থেকে বেরিয়ে এলেন সদরুলসহ কয়েকজন। এরপর ১৯৭৪ সালের ১৬ ই সেপ্টেম্বর সদরুলসহ কয়েকজন মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও সদরুল পাশা। এর মাধ্যমে শুরু হলো থিয়েটারের ইতিহাসে আরেক অধ্যায়ের। যে দল শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে অনেক মঞ্চ সফল নাট্য প্রযোজনা উপহার দেয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান লাভ করেছে। সে সময়ে সদরুলের গতিশীল নেতৃত্ব, সমসাময়িক নাট্য আন্দোলনে তাঁর আধুনিক চিন্তাধারা ও মৌলিক উপস্থাপনা উক্ত কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। অরিন্দম থেকেও সে সময় একাধারে যামিনীর শেষ সংলাপ, ফলাফল নিম্নচাপ, মল্লিকার চোখে জল, শনিবার, ভোলাময়নার বায়স্কোপ ইত্যাদি মঞ্চসফল প্রযোজনা চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পেল। এ সময়টাকে বলা যায় চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তখনকার সময়ের অনেক নাট্যকর্মী ও নাট্যামোদী দর্শক উক্ত নাটকগুলোতে বিশেষ করে “যামিনীর শেষ সংলাপ” কিংবা “ফলাফল নিম্নচাপ”- এ সদরুল পাশার প্রশংসিত অসাধারণ অভিনয়ের কথা মনে করে এখনও আবেগ তাড়িত হন। ইতিহাস হয়ে আছে সে সময়ে চট্টগ্রামে অরিন্দমের নাটকের টিকেট কালোবাজারী হওয়ার মত ঘটনা। যা এখন শুধুই কল্পনা। এত কিছুর পরও নিজের হাতে গড়া অরিন্দমেও চঞ্চল যুবা সদরুল থিতু হতে পারলেন না। এক সময় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হোক কিংবা মান অভিমানের পালায় হোক তিনিও দল ছেড়ে যান।
সদরুল ছিলেন চট্টগ্রামের বনেদী পরিবারের সন্তান। বলা যায় বহু বিচিত্র ছিল তাঁর জীবন। হওয়ার কথা ডাক্তার কিন্তু হয়েছেন অভিনেতা সংগঠক। ভারতের পুনায় থাকাকালীন বোম্বের আনীজ পদোমসি নামে এক ব্যারিস্টার মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেন সদরুল। পরবর্তী সময়ে সদরুল তাঁর কর্মজীবন এই আনীজের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও চেষ্টায় কার্যকর করতে সচেষ্ট হন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মগবাজারে একটা এপার্টমেন্টে তাঁদের একমাত্র শিশু সন্তান আলিফকে নিয়ে শুরু করেন সংসার জীবন। “সৃষ্টি” নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা গড়ে তুলে তার ব্যানারেই একের পর এক তৈরি করতে থাকেন বিজ্ঞাপন চিত্র, তথ্যচিত্র, টিভি নাটক ইত্যাদি। চট্টগ্রামের মঞ্চ কাঁপানো সদরুল ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনেরও অন্যতম অভিনেতা হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
চট্টগ্রামে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে নাট্যচর্চার ইতিহাসে অবশ্যই একটি নাম প্রথম সারিতে থাকবে সেটি হচ্ছে সদরুল পাশা। এটা অনস্বীকার্য যে ইতিহাসই চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার স্বাধীনতাত্তোর গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে একক সংগঠক হিসেবে সদরুলের জন্ম দিয়েছে। যে সদরুলকে বলা যায় চট্টগ্রামের নব নাট্য আন্দোলনের পুরোধা। যাঁর মধ্যে বিরাজিত ছিল থিয়েটার কর্মযজ্ঞের এক বিশাল সম্ভাবনার ভান্ডার। যিনি সে সময়ের সকল বাধা বিপত্তিকে জয় করে দিনরাত একাকার করে মঞ্চ দাপিয়ে বেরিয়েছেন অবলীলায়। ১৯৯৫ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর মাত্র ৪১ বছর বয়সে বড় অসময়ে মৃত্যুবরণ করেন সদরুল পাশা!
সদরুল পাশা সবসময় বিশ্বাস করতেন শিল্পীদের কমিটেড হতে হবে। আজ সূচনা পরবর্তী নাট্যাঙ্গনের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। এক্ষেত্রে দায় কার তা সময়ের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়ে শুধু এটুকু বলা যায় এই সময়ে সদরুলের মত আত্মবিশ্বাসী ও নিবেদিত প্রাণ শিল্পীর বড়ই প্রয়োজন ছিল। তাই স্বাধীনতাত্তোর চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পথিকৃৎ সদরুল পাশাকে ব্যাপকভাবে স্মরণ করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাহলে বর্তমান প্রজন্মের নাট্যকর্মীরা তথা নাট্য সংশ্লিষ্ট সকলেই এই অসামান্য প্রতিভা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি তাদের পূর্বসূরীদের ভালো কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে এক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হবে। তাহলেই হয়ত সদরুল পাশা নাট্যাঙ্গনকে যা দিয়েছেন তা বৃথা যাবে না।
(লেখক : নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী)