শিরোনাম

South east bank ad

মিয়ানমার সরকার সমর্থনে রাশিয়া-চীনের দ্বৈতনীতি

 প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   আন্তর্জাতিক

মিয়ানমার সরকার সমর্থনে রাশিয়া-চীনের দ্বৈতনীতি

মর্তুজা মিশু:

ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বেশির ভাগ সময় সেনাশাসন চলেছে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল নি উইন। সরকার পরিচালনার জন্য বেসামরিক প্রশাসন যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। পরের ২৬ বছর সরকার পরিচালনা করেন নি উইন। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় পায়।
২০১৬ সালের মার্চে হতিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে দেশটিতে নতুন যুগের সূচনা হয়। প্রায় ৫০ বছরের সেনা আধিপত্যের পর সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।
প্রথম মুক্ত নির্বাচনের চার বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন এনএলডি এবং সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল ৩৩ আসন।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী ‘কারচুপি’র অভিযোগ তোলে। সেসময় থেকে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকে সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন ওঠে। অবশেষে সেই গুঞ্জন বাস্তবে পরিণত হয় ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২১। দেশে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছে এবং সব ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনী তার এখতিয়ারে নিয়েছে। এ অধ্যায়ের কৌতূককর দিক হলো, সেনাবাহিনী জানাচ্ছে তারা সংবিধানের বিধান অনুযায়ীই ক্ষমতা নিয়েছে। তারা একজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও নিয়োগ দিয়েছে। দেশটিতে গণতন্ত্রের জমিন শক্ত হতে দিতে চান না জেনারেলরা। তাঁদের পেছনে আঞ্চলিক মদদও আছে।
সু চি এবং এনএলডি গত নির্বাচনের চেয়েও এবার বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হতে চলেছিল। মিয়ানমারজুড়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে ভোট হয় ১ হাজার ১৭১টি আসনে। এবার ভোট হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ আসনে এবং তাতে সু চির দল একাই পেয়েছে ৯২০ আসন, যা গতবারের চেয়েও ৬৬টি বেশি। এভাবে কয়েক মেয়াদে দেশটিতে রাজনীতিবিদদের বেসামরিক সরকার কাজ করলে সমাজে সশস্ত্র বাহিনীর পুরোনো কর্তৃত্ব কমে আসার যে প্রবণতা শুরু হবে, সেটা হতে দিতে চাইছে না জেনারেল গোষ্ঠী। বিশেষ করে সর্বশেষ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থক রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) অত্যন্ত খারাপ ফল করে। তারা মাত্র ৭১টি আসন পায়, যা গতবারের চেয়ে ৪৬টি কম। মূলত এই ঘটনায় সেনাবাহিনী জনগণের স্বাধীন মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। ইউএসডিপি এ রকম খারাপ ফল করবে এটা ‘টাটমা-ড’ নামে পরিচিত মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী এবং তার গোয়েন্দা অনুমানকেও বোকা বানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ অনেক কমে যায়।
সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ভেবে রেখেছিলেন ইউএসডিপি নির্বাচনে ভালো করলে সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করে তিনি উর্দি ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হবেন। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাঁর সেই ইচ্ছায় বাদ সাধে। বলা যায়, গত নভেম্বরের ভোটে সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনামতো কিছুই হয়নি। এই কারণে ভোটের পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। অার এটাকে কেন্দ্র করেই মূলত ১লা ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় সেনা অভ্যুত্থান ঘটে।

রাশিয়া চীনের দ্বৈততার কারন কি?
এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে কোন দেশ বেশি লাভবান হবে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এখন অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে, মিয়ানমারে ক্রমবিকাশমান গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ায় এবং আবারও সামরিক শাসন আসায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন। প্রায় ৫০ বছরে সামরিক শাসনের সময় যখন পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো মিয়ানমারের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল তখন মিয়ানমারের জান্তা সরকার চীনের উপরই অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
এবারের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম হয়ে দাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো আবারও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে। কিন্তু এতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিচলিত হবে বলে মনে হয়না। কারণ চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি তাদের পাশে রয়েছে।
মিয়ানমারে চীনের সরকারি-বেসরকারি বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটিতে অবকাঠামো নির্মানসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। এসব কারণে মিয়ানমারের সাথে চীনের জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই।।
অন্যদিকে রাশিয়ার সাথেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে থাকে। সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েকদিন আগেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিয়ানমারে এসেছিলেন দেশটিতে অস্ত্র বিক্রির একটি চুক্তি সই করতে। রাজধানী নেইপিডোতে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয় সামরিক বাহিনী।
অন্যদিকে সূচি সরকারের সময়েও চীন বড় বড় সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদান করেছে। রাশিয়া ভাগিয়ে নিয়েছে বড় বড় অস্ত্র ক্রয়াদেশ। সব মিলেয়ে রাশিয়া চীন দুদেশই সূচি এবং জান্তা সরকার দুটোরই সদ্ব্যবহার করে নিচ্ছে। অার যুদ্ধ এবং সামরিক কলাহল যতো বেশি অস্ত্র বিক্রয় ততো বাড়বে রাশিয়ার। তাই কৌশকগতো কারনে রাশিয়া জান্তার পক্ষে চাপাই গাইছে। অার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীও চীনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে রাশিয়ার সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল বেচে নিয়েছে।
রাশিয়া-চীনের সমর্থনের কারনে অন্তর্জাতিক চাপ কোনঠাসা :
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, নিজ দেশের জনগণরর ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তার রক্তক্ষয়ী দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপে বাধা দিচ্ছে চীন ও রাশিয়া। এ দুটি দেশের বাধার কারণে জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া বিবৃতিটিতে সেনাবাহিনীকে সংযত হওয়ার আহ্বান এবং তা না হলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিরাপত্তা পরিষদ গত মাসেও এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ঘোষিত জরুরি অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ও আটককৃতদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এদিকে ব্রিটেনের তৈরি করা হুঁশিয়ার খসড়াটি সংশোধনের জন্যে চীন, রাশিয়া, ভারত ও ভিয়েতনাম পরামর্শ দেয়। তারা বিবৃতি থেকে সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কিত আলোচনা ও ‘সেনাবাহিনী সংযত না হলে আরও ব্যবস্থা গ্রহণ’র মতো কথাগুলো সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানায়।
অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া :
বিবৃতিতে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ঘোষিত জরুরি অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ও আটককৃতদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।তখনও চীন-রাশিয়ার বিরোধিতায় বিবৃতিটিতে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানানো হয়নি।
অার নাফ নদীর এপাড়ে বাংলাদেশ থেকে রহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যখন কিছুটা অালোচনা শুরু হচ্ছি তখন ই সেনা অভ্যুত্থান অামাদের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়ালো। অার জান্তা সরকার ১ বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষনা করে ক্ষমতা দক্ষল করলে তা বেড়ে হতে পারে কয়েকবছর যেটা ১৯৪৮ এর পর থেকেই হয়ে অাসছিলো মিয়ানমারে।
(লেখক: মর্তুজা মিশু, ব্যাংকার ও কলামিস্ট)

BBS cable ad

আন্তর্জাতিক এর আরও খবর: