দুগ্ধ শিল্পের উন্নয়ন মানে গ্রামের সমৃদ্ধি
আহসান খান চৌধুরী :
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুগ্ধ শিল্প একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিশেষ করে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে এটা একটা প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। দেশ গড়ার জন্য যেমন অবকাঠামো দরকার, তেমনি স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠনে দরকার পুষ্টি। পুষ্টির অন্যতম ভিত্তি হলো দুধ। কারণ দুধ একটি আদর্শ খাবার। যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য দুধ অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া বেকার সমস্যা দূরীকরণ, জ্বালানি সমস্যা সমাধানে এ খাতের বড় অবদান রাখার সুযোগ আছে।
দেশের সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও দুগ্ধ শিল্প আশানুরূপ বিকাশলাভ করতে পারেনি। অথচ দেশের দুগ্ধ শিল্পে ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া তেমন কোনো বৃহৎ উদ্যোগ নজরে পড়ে না। আমাদের দেশে এখনো দুধের জন্য গবাদিপশু পালনকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। পরিবারের দুধের চাহিদা মেটাতে কেউ কেউ কেবল গাভী পালন করে। গবাদিপশু পালনকে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের মূল আয়ের উৎস হিসেবে ভাবা হয় না। ফলে আমদানীকৃত গুঁড়ো দুধ দিয়ে দেশে দুধের চাহিদা মেটাতে হয়। দুধ আমদানিতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক তরল দুধের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। সেখানে দেশীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৯৯ লাখ টন, যা মোট চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক গড় দুধের চাহিদা রয়েছে ২৫০ মিলিলিটার। এর বিপরীতে পর্যাপ্ততা রয়েছে ১৬৫ মিলিলিটার। তবে মানুষের দুধ গ্রহণের হার ক্রমেই বাড়ছে। এছাড়া আগামী দিনগুলোতে নগরায়ণ ও মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রক্রিয়াজাত দুধের চাহিদা বাড়বে।
কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বহুমুখী সামাজিক প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়ে। প্রথমত, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এ খাত সরাসরি প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয়ত, গ্রামে বহু বেকারের চাকরির সুযোগ করে দেয়। এছাড়া এ খাত অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে। নতুন চাকরি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দুগ্ধ শিল্প খাত এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দুগ্ধ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে এক কোটির বেশি মানুষ এবং এ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আরো বড় আকারে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। কারণ দুগ্ধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। একসময় খাদ্যেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। সরকার ও অন্যান্য বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে।
দেশে প্যাকেটজাত দুধের বড় উৎস উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। এর মধ্যে দুধের জেলা হিসেবে খ্যাত সিরাজগঞ্জ ছাড়াও রয়েছে পাবনা, নাটোর, রংপুর ও বগুড়া। এর বাইরে বর্তমানে যশোর ও সাতক্ষীরা থেকে দুধ সংগ্রহ করছে কোম্পানিগুলো। দেশে প্রাণসহ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৪ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে আসছে। দেশে ডেইরি শিল্পের বিকাশে অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরি লিমিটেড। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী কৃষিকে ভালোবাসতেন, কৃষককে ভালোবাসতেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও কৃষককে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ডেইরি শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। যদিও শুরুর পথ মসৃণ ছিল না, অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। দুধ যাতে সহজে ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সংগ্রহ করা যায় সেজন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ডেইরি হাব।
প্রাণের ডেইরি হাব স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা, যাতে তারা ন্যায্যমূল্য পায় এবং দুগ্ধ শিল্পে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। ২০০১ সালে দেশে দুধ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করে প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরি লিমিটেড। ডেইরি হাবের ধারণাটি প্রাণই দেশে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছে। পাবনার চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বাঘাবাড়ী এবং রংপুরে প্রাণের ডেইরির মোট পাঁচটি হাব রয়েছে। এসব হাবের অধীন ১০১টি দুধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র রয়েছে। দুধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্রে খামারিরা সরাসরি দুধ সরবরাহ করে। প্রত্যেক হাবের আওতায় ২০টি দুধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রের মাধ্যমে এর আওতাধীন খামারিদের সব ধরনের সেবা দেয়া হয়। প্রাণ ডেইরির বর্তমানে ১২ হাজার চুক্তিভিত্তিক চাষী রয়েছে যারা গরু পালন করে। এসব চাষীর অধীনে ৫০ হাজার গরু রয়েছে। দুগ্ধখামার করে এসব খামারি নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে এনেছে।
খামারিদের নানা সহায়তা দিয়ে গাভী পালনের জন্য উৎসাহ দেয়া হয়। আধুনিক জ্ঞানের মাধ্যমে কীভাবে দুধ উৎপাদন বাড়ানো যায় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। খাদ্য সংকট মেটাতে সুষম খাবার সরবরাহ করা হয়। এছাড়া গাভী পালনের উপযোগী শেড সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। জাত উন্নয়নের জন্য কৃষকদের গরুগুলোকে কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করে প্রাণ। জাত উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিমেন নিয়ে এসে বাছাই করা গরুতে স্থাপন করা হয়। গরুর রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ও ট্রিটমেন্ট দেয় প্রাণ। (উৎপাদনমূল্যে ডেইরি হাব থেকে এসব ওষুধ সরবরাহ করা হয়)। নিজস্ব ভেটেরিনারি চিকিৎসক দিয়ে অসুস্থ গরুর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া হাবগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিরা খামারিদের বিভিন্ন দিক থেকে প্রায়োজনীয় পরামর্শ ও তথ্য দেয়।
হাবের অধীনে যেসব গাভী রয়েছে তার তথ্য ডাটাবেজ আকারে ডেইরি হাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। খামারিদের হেলথ কার্ড ও প্রডাকশন কার্ড দেয়া হয়। প্রডাকশন কার্ড থেকে গরুপ্রতি উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জানতে পারে খামারিরা। এর মাধ্যমে গাভী পালনের লাভ-ক্ষতির পরিমাণ জানার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি খামার বাড়ানোর জন্য চাষীদের প্রয়োজনীয় অর্থ সহযোগিতার ব্যবস্থা করে প্রাণ। সোনালী ও কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। গরু কেনা ও বাসস্থান তৈরির জন্য এ ঋণ দেয়া হয়। ঋণের টাকা খামারিদের দুধের মূল্য থেকে প্রতি সপ্তাহে কেটে নেয়া হয়। এজন্য তাদের ওপর বাড়তি কোনো চাপ পড়ে না। দুধের গুণাগুণ জানতে সংগ্রহ কেন্দ্র ও কারখানায় নানা ধরনের পরীক্ষা করা হয়। কারণ মানের সাথে বিন্দুমাত্র আপস করা হয় না।
প্রতিদিন গড়ে দুই-তিন লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে প্রাণ। খামারি ও ডেইরি হাবকে সহায়তার জন্য রয়েছে প্রাণ ডেইরি একাডেমি, যেখানে খামারিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া দুগ্ধখামার পরিচালনায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে এ একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রাণের হাবগুলো বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আরো বেশ কয়েকটি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব হাবের মাধ্যমে প্রতিদিন চার-পাঁচ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
প্রাণ ডেইরির বর্তমানে ১২ ধরনের পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইউএইচটি ও পাস্তুরিত তরল দুধ, গুঁড়ো দুধ, ঘি, মাখন, পনির, লাচ্ছি, দই, মাঠা, লাবাং, চিজ ও ফ্লেভার্ড মিল্ক। টেট্রাপ্যাক এবং উন্নত মানের ফুড গ্রেডেড ফয়েল প্যাকে এগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে। আগামী দিনে প্রাণ ডেইরি আরো কিছু পণ্য আনতে কাজ করছে। মূলত দই ও চিজের কিছু ভেরিয়েশন নিয়ে কাজ করছে প্রাণ ডেইরি।
তরল দুধের উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু যে গতিতে বৃদ্ধি পাওয়া দরকার, সে গতিতে বাড়েনি। দেশে এখন গড়ে গাভীপ্রতি দুধ উৎপাদন ছয় লিটার হয়েছে, যা আগে ছিল দুই লিটার। বিশ্বের উন্নত দেশে বিশেষ করে ইসরায়েলে একটি গাভী দৈনিক ৬০ লিটার দুধ দেয়, সে তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। এক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবীর যেসব দেশে উন্নত জাতের গাভী আছে, সেসব দেশ থেকে বীজ সংগ্রহ করে আমাদের পরিবেশের সাথে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, কীভাবে আমাদের কৃষকরা এ ধরনের বাছুর পায় এবং গাভীকে এ পর্যায়ে উন্নীত করা যায়, তার জন্য সরকার উদ্যোগ নিলে তরল দুধের উৎপাদন বাড়বে। বর্তমানে গাভীপ্রতি দুধ উৎপাদন কম হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি হয়।
বর্তমানে দুধের ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর অনেক টাকা ব্যয় করে গুঁড়ো দুধ আমদানি করতে হয়। এ অর্থ যদি স্থানীয় দুধ উন্নয়নে ব্যয় করা যায়, তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। শুধু দুধ উৎপাদন বাড়ালেই হবে না। এ দুধ প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন সক্ষমতাও বাড়ানো প্রয়োজন। যদি তরল দুধ উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেক্ষেত্রে আরো দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুগ্ধ শিল্প গড়ে উঠবে। এতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুগ্ধজাতীয় পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হবে। সুতরাং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও দুধের বাজার সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের অভাবে। দুগ্ধ শিল্পের উন্নয়নে ও বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
দুগ্ধ শিল্পকে অর্থনীতির অন্যতম খাত এবং আরো কর্মসংস্থান তৈরি করতে শুধু তরল দুধ বাজারজাত করলেই হবে না। এর ভিন্নতা আনতে হবে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে আনতে হবে। যেমন শিশুরা দুধ খেতে চায় না। তাই তাদের জন্য ফ্লেভারড দুধ ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে আনা যেতে পারে। ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত পণ্য আমরা সনাতন পদ্ধতিতে ভোগ করছি। এগুলোকে স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করে ভোক্তার কাছে সহনীয় দামে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
দুগ্ধ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে প্রতিটি গ্রামে কৃষকদের গবাদিপশু পালনকে ব্যবসায়িকভাবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষকদের স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রশিক্ষণে পশুপালন ও দুধ উৎপাদনের পদ্ধতি তাদের হাতে-কলমে শেখাতে হবে। তাহলেই দুধের মান বাড়বে। দুগ্ধ শিল্পে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অনেক কম। এ শিল্পে প্রয়োজনীয় গ্যাস ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। তাছাড়া দুধ পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় এর শেলফ লাইফও কম। এছাড়া দুধ প্রক্রিয়াকরণের খরচ অনেক বেশি। আমদানীকৃত গুঁড়ো দুধ সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা সহজ। কিন্তু তরল দুধ পচনশীল। এটা বিতরণের জন্য সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বিপণন ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে। কারণ দুধের চাহিদা সমগ্র বাংলাদেশে রয়েছে। এর উৎপাদন কার্যক্রমও সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।
এ শিল্প ব্যাপকভাবে এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রথমত, দরকার নীতিসহায়তা। বেসরকারি উদ্যোক্তারা যাতে তাদের চাহিদামতো ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে পারেন এবং উন্নত জাতের পশু আমদানি করে দেশে প্রচলন করতে পারেন। পাশাপাশি অর্থায়নে সরকারের সহায়তা লাগবে। ডেইরি শিল্প খুব বেশি লাভজনক শিল্প নয়। তার পরও বিভিন্ন দেশে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের জন্য এ শিল্প গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ডেইরি শিল্পকে যদি ট্যাক্স হলিডে পিরিয়ড দেয়া হয়, ডেইরি মেশিনারি যদি জিরো শুল্কে আমদানি করতে দেয়া হয় এবং সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থ করা হয়, তাহলে এ শিল্প লাভবান হবে। আমাদের প্রচুর দক্ষ মানবসম্পদ লাগবে। দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় পড়ানো হয়, তার সিলেবাস আধুনিকায়ন করতে হবে।
ডেইরি খামার উত্তরাঞ্চলে বেশি। বর্তমানে খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরায় অনেকে কাজ করছেন। এসব খামারের মাধ্যমে অনেকেরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উত্তরাঞ্চলের মতো কাজ করতে পারে, সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে আসতে পারে। বিশেষ অঞ্চলভিত্তিক ডেইরি হাব গড়ে তুলতে স্বল্প সুদে তহবিল দিলেই তা সম্ভব। দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল করতে পারে।
এছাড়া দুধ জনপ্রিয় করার জন্য প্রচারণার অভাব রয়েছে। সরকারকে এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে। দুধ নিয়ে বিশেষ করে প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রচারণা আছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব নিতে হবে জনগণের মাঝে সঠিক তথ্য প্রচারের জন্য। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে দুধের সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে। এ চাহিদা কাজে লাগিয়ে দুগ্ধ শিল্পও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। গরুর বিভিন্ন রোগ আছে, যা এ শিল্পের বিকাশে অন্যতম অন্তরায়। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ভেটেরিনারি মেডিসিন ও গোখাদ্যে সরকার ভর্তুকি দিলে এ শিল্প উপকৃত হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
বেকারত্বের চাপ সামাল দিতে যেসব খাত বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তার মধ্যে গবাদিপশু পালন অন্যতম। দেশে গবাদিপশু পালনে আগ্রহী তরুণের সংখ্যা প্রচুর। তাদের যদি বড় শিল্পের সহায়ক হিসেবে যুক্ত করা যায়, তাহলে বেকারত্বের চাপ কমানো যাবে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্র আরো বাড়াতে হবে। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। এদের আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে এ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দুগ্ধ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান হবে, কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি বিতরণ ব্যবস্থা ও গোখাদ্যের জন্য অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। ফলে অনেক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত আরো মজবুত করা সম্ভব হবে।
আহসান খান চৌধুরী: চেয়ারম্যান ও সিইও, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ