শিরোনাম

South east bank ad

অনিশ্চয়তায় ডুবছে খেটে খাওয়া জীবন

 প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

করোনাভাইরাসের মহামারী রুখতে ছুটি আর বিধিনিষেধে থমকে গেছে রাজধানীর খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা। এক সপ্তাহ আগেও তাদের কেউ প্রতিদিন রিকশা ভ্যান নিয়ে বের হতেন, কেউবা দিন চুক্তির মজুরিতে কাজ করতেন। অনেকে আবার বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে চালাতেন সংসার। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি কিংবা টিনশেড ঘরে এইসব খেটে খাওয়া মানুষের বসবাস। দিনের কাজের টাকায় তাদের বাজার হয়, চুলায় হাড়ি চড়ে। তাদের সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনেও ছন্দপতন ঘটিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারী। মালিবাগ রেলগেইট, ঝিলপাড়, কমলাপুর, রামপুরা, বাড্ডা, ফকিরাপুল ও মোহাম্মদপুর ঘুরে নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে একই হতাশা আর অনিশ্চয়তার ছবি। ভোলার চরফ্যাশনের আলী হোসেন ঢাকায় ইট ভাঙার কাজ করেন। গত সাত দিন বস্তির ছোট্ট ঘরে কর্মহীন কেটেছে তার। পেটের তাগিদে সোমবার সকালে পশ্চিম মালিবাগের বাগাানবাড়ি এলাকায় এক নির্মাণাধীন ভবনের পাশে বেড়ার আড়ালে ইট ভাঙতে বসেছেন তিনি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কী করব স্যার, কাজ করতে মানা। কিন্তু এভাবে থাকলে তো পেটে ভাত জুটবে না। লুকিয়ে ইট ভাংতেছি। কাজ পাইছি চাইর দিন আগে। কিন্তু খোলা জায়গায় তো কাজ করতে পারতেছি না। এলাকার মুরব্বীরা বারণ করছে। আজকে উনাদের বলে কয়ে কাজ শুরু করেছি, বুঝেন তো।” রিকশা চালক তমিজউদ্দিন বাড্ডায় থাকেন। ষাট বছর বয়সেও তাকে রিকশা চালাতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। সোমবার সকাল ৮টায় তাকে মৌচাক মোড়ে বসে থাকতে দেখা গেল যাত্রীর আশায়। আক্ষেপ করে বললেন, “বুড়াকালে আইসা এঠা কী দেখতেছি বাবা জান। ডাক দিলেও প্যাসেঞ্জার রিকশায় উঠতে চায় না। কম ভাড়ার কথা কইছি, তারপরেও কয় ‘যামু না’।” রোজগার এভাবে বন্ধ হয়ে গেলে ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াবেন , সেই চিন্তায় দিশা পাচ্ছেন না তমিজউদ্দিন। মৌচাক মোড়ে একটি রিকশার গ্যারেজের ভেতরে বসে ছিলেন আখলাক মিয়া, সঙ্গে তার বানর ‘রূপবান’। বানর নাচিয়েই তার দিন চলে। আর স্ত্রী বিভিন্ন বাসায় গিয়ে করেন গৃহকর্মীর কাজ। আখলাক জানালেন, গত সাতদিন ধরে তার রোজগারের পথ একেবারেই বন্ধ। তার স্ত্রীকেও কাজে যেতে মানা করেছেন বাড়ির মালিকরা। “তাইলে চলমু কেমনে বলেন? আমার উপার্জনের শক্তি এই বান্দর, তারে ‘রুপবান’ বইলা ডাকি, তারেও খাবার দিবার পয়সা নাই। শিকল দিয়া বাইন্দা রাখছি ৭ দিন হয়। আমরা আর রূপবান সবতেই বন্দি।” করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণ ঠেকাতে চলাফেরা বন্ধ করে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশে অচল হয়ে পড়েছে বিশ্বের বড় একটি অংশ। মানুষকে বাঁচানোর জন্যই এ সতর্কতা, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জন্য তা নিয়ে এসেছে অনাহারে মৃত্যুর শঙ্কা। শান্তিনগরের কাছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেন প্রতিবন্ধী জুলেখা। পোলিওতে তার দুই পা নষ্ট হয়েছে ছোটবেলায়। ভিক্ষা করে এমনিতে প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা যা পাওয়া যেত, তা দিয়েই চলতে হত তাকে। এখন রাস্তায় মানুষ নেই, ভিক্ষার পথও বন্ধ। “গত কয়দিন বস্তিতেই ছিলাম। ঘরে আর মন টিকে না। আইজ সকালে চাইর ঘণ্টা দাঁড়ায়ে ছিলাম, একজন খালি একটা ৫ টাকার কয়েন দিছে। মানুষের দয়ায় বাঁইচ্যা আছি। কাজ করার মত অবস্থাতো আমার নাই। করোনা আমাগো লাইগা গজব। এইটা না গেলে আমরাতো মারা যামু।” আকলিমার বয়স ত্রিশের ঘরে, কমলাপুরের কাছে ঠেলাগাড়িতে করে প্লাস্টিক-এলুমিনিয়ামের জিনিসপত্র ফেরি করেন তিনি। বাবা-মাকে নিয়ে তিনিও পড়েছেন বিপদে। “এখন কেউ এগুলো কিনে না। কাইল শান্তিনগরে দাঁড়াইছিলাম কতক্ষণ। একটা জিনিসও বিক্রি করতে পারি নাই। পুলিশ মাইক দিয়া কইয়া গেছে- কেউ দাঁড়াবার পরব না। আমরা এখন কই যামু, বুঝতাছি না।” মালিবাগের বাগান বাড়ির কাছে দেখা গেল রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি রিকশা ভ্যান। মালিক আব্দুস সাত্তার বললেন, “দোকান-পাট, অফিস-আদালত বন্ধ। মাল টানার কাজ নাই। গাড়ি চালানোরও লোক নাই, অনেকে দেশের বাড়ি চলে গেছে।” রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লা রোডের কয়েকজন তরুণ দুস্থদের সহায়তায় চাল, ডাল, তেলের ব্যবস্থা করেছেন খবর পেয়ে সোমবার আশপাশের বস্তি থেকে ছুটে আসেন বেশ কিছু নারী। প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়া রিকশাওয়ালারাও ভিড় করেন। বাঁশবাড়ি বস্তির হোসনে আরা, জমিলা, আখতারুন্নেসা জানান, তারা বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিন্তু এই ‘অসুখ-বিসুখের’ সময়ে বাড়ির মালিকরা কাজে যেতে মানা করে দিয়েছেন। আজহার নামের এক রিকশা চালক বললেন, সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত রাস্তায় থেকে তিনি কেবল ২০ টাকার ‘খ্যাপ’ পেয়েছেন। তার ঘরে দুই শিশু সন্তান, স্ত্রী ও মা রয়েছেন। চালডাল দেওয়ার খবর পেয়ে পেয়ে তিনি ছুটে এসেছেন। যে তরুণরা এই সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের একজন বাহাউদ্দিন। তিনি বললেন, “চাল, ডাল, তেল, মুড়ি, আলু, সাবান একত্র করে প্যাকেট করে আমরা দিতে চাচ্ছি। কিন্তু প্যাকেট করার সময়টুকুও তারা দিতে চায় না।” স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবু সায়েম শাহীনও গত দুদিন ধরে গভীর রাতে খাদ্যসামগ্রী বিলি করছেন বলে জানালেন। তিনি বললেন, সব পর্যায় থেকে এভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। মালিবাগের আবুজর গিফারী কলেজ এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব হাবিবুর রহমান এক সময় সরকারি চাকরি করতেন। কোনো রোগের কারণে মানুষের জীবন এভাবে বদলে যেতে তিনি কখনও দেখেননি। “আমারা এখন জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। কিন্তু এর পরণতি কী? এখন প্রান্তিক মানুষের জীবন বাঁচানোর বিষয়টায় প্রায়োরিটি দেওয়া জরুরি। আর উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। তার মতে, বাসায় বাসায় খাবার পৌঁছে দিলে বা কিছু ত্রাণ দিলে আপাতত তাদের দিন চলবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে।
BBS cable ad

সম্পাদকীয় এর আরও খবর: