শিরোনাম

South east bank ad

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?

 প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০১৮, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?
শেখ আবু তালেব: বাণিজ্য বেসাতির পাল তোলা নৌকা এক সময়ে শুধু অর্থ আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত ছিল। কয়েক দশক আগেও শুধু আয় বৃদ্ধিতে বাণিজ্য সম্প্রসারণে রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে বাণিজ্য সুবিধা আদায়ই প্রাধান্য পেত। কূটনীতির চালটা দেওয়া হতো বাণিজ্য বৃদ্ধিতে। এখন আঞ্চলিক স্বার্থ আদায়, প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যের বাইরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও কূটনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে, আবার কূটনীতিক প্রয়োজনে অর্থনীতি চালকের আসনে চলে আসছে। যেভাবেই হোক অর্থনৈতিক কূটনীতি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠিতে পরিণত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায় সাগর পাড়ের ভূমির কাঠামোগত অনন্য বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের কাছে। ব-দ্বীপ বলয়ের হওয়ায় এশিয়ায় যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তারে ভূ-কৌশলগত প্রয়োজনে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কোনো পরিকল্পনাই সম্ভব নয়। আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় বিশ্বের ২০২টি দেশ থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করে। অন্যদিকে রফতানির জন্য ১৮৮টি দেশের সঙ্গে নিয়মিত লেনদেন করতে হয়। বিশাল সংখ্যক দেশ হলেও আমদানিতে শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে চীন, ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, জার্মানি, কোরিয়া, ব্রিটেনই বেশি। অন্যদিকে রফতানিতে আমেরিকা, স্পেন, ব্রিটেন ও ইউরোপের দেশই ভরসা। এ দেশগুলোর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের শ্রমবাজারের সম্পর্ক রয়েছে। সীমান্ত দেশ মিয়ানমার ও আঞ্চলিক যোগাযোগের সার্ক দেশগুলো ঘিরেই আমাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রাধান্য পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মোট আমদানির ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে দেশটির পণ্যে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বৈধ পথে আসছে মোট আমদানির মাত্র ১৫ শতাংশ। আমদানিতে প্রথম অবস্থানে চীন, দ্বিতীয় ভারত ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির প্রাণ রফতানি আয়ে বাংলাদেশের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশ। অথচ আমদানি দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অষ্টম। ১১তম অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। রফতানি তালিকায় ভারতের অবস্থান ১১তম। বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় দুই শতাংশ ভারতে যায় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে। আবার ভারতের রেমিট্যান্স আহরণে চতুর্থ সর্বোচ্চ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বিবেচনা নিলে চীন, আমেরিকার পরেই ভারতকে স্থান দিতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত থাকায় ভৌগোলিক দিক দিয়ে ভারতকে প্রথমেই রাখতে হয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। বাণিজ্য ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে সমঝোতা করে। আগে যেখানে শুধু রাজনৈতিক কারণটিই সম্পর্কের ভিত বলে বিবেচনা করা হতো। সেখান থেকে সরে আসছে সব দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকার যুদ্ধ-যুদ্ধ উত্তেজনা ও পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে কিম ও ট্রাম্পের বৈঠক। সবই হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। অন্যদিকে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্বও নিষ্পত্তি হয়েছে অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের কারণে। স্বার্থের জায়গাগুলো বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে গেছে অর্থ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে গিয়ে চীন-ভারতের বাণিজ্য আলোচনা দোকলাম ইস্যুর উত্তেজনাকে শীতল করেছে। এভাবেই অর্থনৈতিক কূটনীতিতে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পেরেছে দেশ দুটি। ভূপ্রকৃতির কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পরাশক্তি দেশ বিশেষ করে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোও বেশ জোরালো। বাংলাদেশকে যেমন চীনের প্রয়োজন, তেমনি রফতানি আয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের। আবার অর্থের উৎস ও সীমান্ত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশকে বেশি প্রয়োজন ভারতের। কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স আয়ের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর। একই কারণে প্রয়োজন ইউরোপ ও এশিয়ার মালয়েশিয়াকে। শুধু রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ওপর জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে তার হিসাব কষলে হয়তো এর বিকল্প বা এতদূর যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ সতর্ক হতো। এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত হওয়ায় এখনও বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই শুল্ক ছাড়া পণ্য আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশ হলে তাদের শুল্ক দিতে হবে। তখন পণ্যর দাম বৃদ্ধি পাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। ভবিষ্যতে এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার উপায় হচ্ছে দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা এফটিএ করা। এই চুক্তির ফলে দুটি দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানিতে শুল্কারোপ হয় না। বাংলাদেশ গত ১০ বছরের অধিক সময় ধরে চেষ্টা করছে এই চুক্তি করার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবুজ সংকেত দেয়নি কোনো দেশ। সরকারি উদ্যোগের ফল শূন্য। শুধু শ্রীলঙ্কার বেলায় কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের মূলভিত্তি ধর্মীয় কারণে। কিন্তু বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফলে আরব দেশগুলো পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে ধর্মকে পাশে রেখে তারা শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আমেরিকা, ইসরাইল, ব্রিটেন, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ফ্রান্সের মতো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন শুরু করেছে। যাকে তারা আরব বসন্ত নামে ডাকে। বৈশ্বিক এ পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে তা বিশ্লেষণ করার সময় হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এ নীতির ফলে আমাদের শ্রমবাজারের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। ফুটবল বিশ্ব কাপের ভেন্যু নির্ধারণী ভোট নিয়ে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ধর্মীয়ভাবে বৈসাদৃশ্য থাকার পরও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভারতের শ্রমবাজার প্রসারিত হচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। চীন নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে। সেই ব্যবস্থায় পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার যোগ দিয়েছে। ভারত এখনও যোগ দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের যোগ দেওয়াটা দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব রাখবে, তা সরকারি পর্যায়ে এখনও কোনো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তার কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলো অভ্যন্তরীণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। ভারতের সঙ্গে নদীর পানি বিশেষ করে তিস্তা ও সীমান্তে গড়ে ওঠা মাদকের কারখানা ইস্যুগুলোর কোনো সমাধান করতে পারেনি বাংলাদেশ। নতুন করে অর্থনৈতিক আরও কয়েকটি ইস্যু যোগ হচ্ছে আমাদের অজান্তেই। বাংলাদেশ যে পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাসীদের মাধ্যমে পাচ্ছে, তার প্রায় সমপরিমাণ ডলার চলে যাচ্ছে ভারতে। বাংলাদেশ এখন ভারতের চতুর্থ রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ। কর্মসংস্থানের অভাবে যেখানে প্রতি বছর ১৫ লাখ মানুষ কাজ পায় না। সেখানে ভারতের জনবলের কর্মসংস্থান হচ্ছে বাংলাদেশে। বিষয়টি এখনও চিহ্নিত করা হয়নি। ভবিষ্যতে তা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর্থিক লেনদেনে ভারতের প্রতিশ্রুতির চেয়ে চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তা কি শুধু অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না প্রভাব বিস্তারে ব্যবহৃত হবে? বাংলাদেশে গত দুটি নির্বাচনের পরে ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দৃশ্যমান বেশকিছু কর্মকাণ্ড ভাবিয়ে তুলতে পারে চীন, মিয়ানমার ও আমেরিকাকে। অতীতে নেপালের সঙ্গে ভারতের এ রকম সম্পর্ক বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল দেশটিকে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসছে নেপাল। বাংলাদেশ এই সময়ে সেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে তা কোনো বিবেচনায় বুঝা যাচ্ছে না। এমন সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক প্রভাব যে মোটেও ভালো হবে না তা নেপালকে দৃষ্টান্ত হিসেবে রাখলে সহজেই বুঝা যায়। এসব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা এখন ছোট্ট বাংলাদেশের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপির আকার এখন ২৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দৌড়ে অনেক পিছিয়ে। সামনের দিনে অর্থনীতিই হবে এশিয়ার পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার। যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে, তার প্রভাব ততই স্থায়ী হবে। শুধু অর্থনীতি বড় হলেই হবে না, তার প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী চিন্তা ও সঠিক কার্যকর পরিকল্পনা। দক্ষ ও বিচক্ষণ কূটনীতি ছাড়া তা সম্ভব নয়। এজন্য ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে আমাদের কূটনৈতিক চর্চাকে। বিশেষ কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রেখে পুরোনো সেই নীতি বদলের। স্বার্থ ও ইস্যুভিত্তিক বহুমাত্রিক কূটনৈতিক হবে বাংলাদেশকে। ভারতকে যেমন উপেক্ষা করা যাবে না, তেমনি চীনকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে এবং মার্কিনকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতিতে চলতে হবে দেশকে। আর সবকিছুর অভ্যন্তরে কলকাঠি হলো আর্থিক ভিত্তি। অর্থনৈতিক এ কূটনীতিতে কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ তা বলার সময় এখনও হয়নি। ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারণে অর্থনৈতিক এসব সম্পর্কের প্রভাব ও বিকল্প নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। দেশগুলোর সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক বা বহুমাত্রিক সম্পর্কে জড়ানোই বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন এক জাতি। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আর্থনীতির যে কূটচাল চলছে, তাতে সফল না হলে দুর্বল হবে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষতার সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ভবিষ্যতে টিকে থাকা সম্ভব হবে। গণমাধ্যমকর্মী [email protected]
BBS cable ad

সম্পাদকীয় এর আরও খবর: