আন্তর্জাতিক কূটনীতির বেড়াজালে রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণ
মিয়ানমার থেকে ছয় লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা জনস্রোত থামছে না। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাস্ত্রহীন জনগোষ্ঠী হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গরা চিহ্নিত। বহু জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত মিয়ানমারে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠী বারে বারে নিষ্পেষিত হয়েছে সেনা শাসকদের হাতে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসাবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি’র সম্মানের মুকুটগুলো একে একে স্খলিত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মানবতার বিপর্যয়ে রুখে দাঁড়াবার নৈতিক সাহস বিবর্জিত হয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছেন। দুই মাসের অধিক সময় পার হলেও মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকদের ফেরত নেবার কোনো প্রক্রিয়া শুরু করেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুই দেশের মন্ত্রীদের সফর বিনিময় হলেও কোনো সুরাহার লক্ষণ না দেখা গেলেও বাংলাদেশের সক্রিয় কূটনীতির সুবাদে বিশ্বে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবার বিবৃতি বাংলাদেশের অর্জনে নতুন যোগ হলো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটোর মুখে কোনো প্রস্তাব না উঠলেও পরিষদ সভাপতির ভাষণ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। মিয়ানমার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের বোঝা বহন করা দুষ্কর। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ক্ষোভ ও দুর্ভোগকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদে যুক্ত করা অসম্ভব নয়। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারসহ তাদের বাস্তুভিটায় পুনর্বাসিত করা অত্যন্ত জরুরি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতু ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় দেশ হিসাবে মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের স্তম্ভ হিসাবে মিয়ানমার চীনের কাছে আদরণীয়। দেশটিতে নতুন বাজার ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা সবাইকে সমানভাবে আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি থেকে সুবিধা পাওয়া দেশগুলো স্বভাবতই আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা খুব অর্থবহ। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চলমান আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিজ নিজ দেশের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থকে ঘিরে প্রবাহিত হচ্ছে।
মার্কিনি উদ্যোগের তীব্রতা এবং বিশ্বনিন্দার মুখে মিয়ানমারকে অন্ধভাবে সমর্থন দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে চীনকে অনড় দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে রাশিয়ার সমর্থন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে ভারতের কূটনীতিকরা যোগাযোগের মাত্রা আগের থেকে বাড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে চীন তার স্বার্থ আদায় করার কৌশল হিসাবে সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা, সেনা অভিযানের নামে রোহিঙ্গা জাতি নিধন ও গণহত্যা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে না। রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়নকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে পরিগণিত করে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখার নীতিতে এখন অটল। অপরদিকে মার্কিনিরা মিয়ানমারের সহিংসতার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন, ভারত ও রাশিয়া দ্বিপাক্ষিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পাওয়ার উপায় নিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
২৫ আগস্টে ৩০টি সীমান্তরক্ষী ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের সন্ত্রাসী সংগঠনের হামলাকে অজুহাত করে সেনাবাহিনীর চালানো সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রাণঘাতী পরিকল্পনা মিয়ানমার সেনাবাহিনী অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিল এবং সন্ত্রাসী হামলাকে উপলক্ষ করে তা কার্যকরী করেছে মাত্র। অং সান সুচি’র রাজনৈতিক সরকার নির্বিকার ছিল। আরসা সন্ত্রাসীদের অস্তিত্বের বাস্তবতা থাকলেও তাদের সংগঠনটি আকারে ছোট, নেতৃত্ব দুর্বল, অপ্রশিক্ষিত এবং দেশীয় অস্ত্রের বাইরে কোনো আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারেনি। হাতে তৈরি কিছু বোমা দেখা গেলেও আরসা দমন করতে সেনাদের অনিয়ন্ত্রিত বল প্রয়োগ ছিল অচিন্তনীয় এবং বহুল মাত্রায় অতিরিক্ত। অসংখ্য মানবতা-বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। গণহত্যার সুস্পষ্ট চিহ্ন রেখে গেছে সেনাবাহিনী। সেনাদের সঙ্গে সমঝোতা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকা গণতন্ত্রী নেতা অং সান সু চি সেনাদের দায়ী না করে বরঞ্চ নিজে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে সহিংসতার অস্তিত্ব অস্বীকার করে চলেছেন।
গত ৬৫ বছরের সামরিক শাসনকালে সেনাবাহিনী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শান, কারেন, কাচিন, কারেনিস, মন, চিনসহ হাজার হাজার সংখ্যালঘুদের হত্যা করেছে। তবে জাতি নিধন ও গণহত্যার শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। কারণ সেনাদের মুসলিম ভীতি আতঙ্কে রূপ নিয়েছিল। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ বর্মণ বাদে অন্য সব জাতি গোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহ করেছে। মূলত ১৯৬২ সালের সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের ফেডারেল পদ্ধতি চালু বন্ধ করতে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অর্ধশত বছরের সামরিক শাসনে অভ্যস্ত সেনাকর্তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে কখনই সম্মত ছিল না। পশ্চিমা বাণিজ্যিক ও অস্ত্র অবরোধের মুখে গণতন্ত্রের পথকে উন্মুক্ত করলেও নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে নিজেরাই সংবিধান তৈরি করে নির্বাচনের আয়োজন করলে পশ্চিমারা যেমন স্বস্তি পেয়েছিল ঠিক তেমনি অং সান সু চি ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর তৈরি করা সংবিধানের কারণে তিনি দেশের বিধিবদ্ধ সরকার প্রধান হতে পারেননি। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিকাশের পথ সুগম করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সাল থেকে অবরোধ শিথিল করতে থাকে এবং ২০১৬ সালের অক্টোবরে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে। মিয়ানমার বিশ্বের কাছে নতুন বাজার ও বিনিয়োগের লক্ষ্যে পরিণত হয়। এক বছরের মাথায় আবার অবরোধের চাপে পড়েছে দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতনের জন্য সেনা নেতৃত্বকে দায়ী করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর টিলারসন সুস্পষ্টভাবে সেনা কর্তৃত্বকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন এবং রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তদন্তের দাবি থেকে সরে আসতে চাচ্ছেন না। ৪২ জন কংগ্রেসম্যান চিঠি লিখেছেন লক্ষ্যকেন্দ্রিক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে। সিনেটে বিল উপস্থাপন করতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের যৌথ উদ্যোগ লক্ষণীয়।
ইয়াঙ্গুনে অং সান সু চি’র দল এনএলডি আন্তধর্মীয় সমাবেশ করে দেখাতে চেয়েছে মিয়ানমার বহু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। যদিও রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু উচ্চারিত হয়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আইন পাস করার উদ্যোগের খবর বের হলে সহিংসতার দুই মাস পর তড়িঘড়ি করে অং সান সু চি রাখাইন রাজ্য সফর করে দেখাতে চেয়েছেন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রয়েছে।
মিয়ানমার শুরু থেকে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে অস্বীকার করে এসেছে। সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান বলে রোহিঙ্গা বিতাড়নকে রাষ্ট্রের বৈধ অধিকার বলে দাবি করছে। কিন্তু ৬ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি আড়াল করার কোনো অবকাশ নেই। মিয়ানমারের স্বপক্ষে চীনের শক্ত অবস্থানকে রাশিয়া সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আঝদার কুরতভ মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি সরাতে পশ্চিমা বিশ্বের অপচেষ্টা। রোহিঙ্গা সংঘাতের সব দিক বিবেচনা নেবার পরামর্শ দিয়েছে, যা মূলত মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নিকট-বন্ধু হচ্ছে চীন। সেনা অভিযানকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বিবেচনা করে হস্তক্ষেপের বাইরে রাখতে চেয়েছে। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক, বিনিয়োগ ও কৌশলগত সম্পর্ক অনেক গভীরে শেকড় গেড়েছে। রাখাইন রাজ্যের ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের গভীর সমুদ্র বন্দর চীনকে বঙ্গোপসাগরে সংযোগ দিয়েছে। মিয়ানমারের পাশে থেকে চীন ইতোমধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দরের শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসাবে মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি তাত্পর্যপূর্ণ। এটা চীনকে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক কৌশলগত অবস্থান তৈরিতে সহায়তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের সুবিধাকে উল্টে দিতে মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়নকে সস্তা বিকল্প হিসাবে দেখছে এবং রোহিঙ্গা সংকটকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থায় সেনা কতৃত্বকে খর্ব করতে প্রয়াসি হয়েছে। সেনাবাহিনী চীনের আধিপত্য রক্ষায় বেশি মনোযোগী এবং আগ্রহী। রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা ঠেকাতে চীন ইতিমধ্যে মানবিক সাহায্য দিতে অঙ্গীকার করেছে, কিন্তু সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে মিয়ানমারকে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার-বিরোধী নিন্দাপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীনের ভেটো সদা প্রস্তুত।
অং সান সু চি ও তার নেতৃত্বকে আমাদের সমর্থন করা দরকার এবং সরকারের সঙ্গে সেনাদের ক্ষমতার অংশীদারি অগ্রহণযোগ্য। সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। নির্যাতন বন্ধ হতে হবে। জাতি নিধন বন্ধ হতে হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করেছে তার অবস্থান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক কূটনীতি স্বার্থ হাসিলের চক্রে ঘুরছে এবং পারস্পরিক দর কষাকষির ইঙ্গিত বহন করছে। অবরোধ আরোপের পথ থেকে মার্কিনিরা হঠাত্ সরে গিয়ে কূটনৈতিক সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ার পর চীন নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির ভাষণকে গ্রাহ্য করল। ভারতের উদ্যোগে সক্রিয়তা বাড়ল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ চীন, ভারত ও রাশিয়াকেও আঁকড়ে ধরবে। সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উপায় বের না হওয়া পর্যন্ত কূটনৈতিক তত্পরতাকে অব্যাহত রাখতে হবে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর আধিপত্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং বাংলাদেশের জন্য সহায়ক নয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে অবলম্বন করেই সমস্যার সমাধান ত্বরান্বিত করতে হবে।
n লেখক :স্ট্রাটেজি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইন্সটিটিউট অফ কনফ্লিক্ট, ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আই ক্লাডস) এর নির্বাহী পরিচালক