শিক্ষকরা যখন ফেল করেন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, আছে শিক্ষাদানের নিজস্ব ঘরানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ জানান দিয়েছে এই বিভাগ বা বৃহত্তর অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়টি কোন ঘরানার। উচ্চশিক্ষা যোগ্যতার ওপর দাঁড়ায়, তা পাইয়ে দেওয়া যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রশ্নপত্রের একাধিক প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তো আছেই, যাঁরা প্রশ্ন করেছেন অর্থাৎ এই অনুষদের শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। গত ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত চারকলা অনুষদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ৭৬ নম্বর ক্রমিকের প্রশ্নে বলা হয়- ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কি?’ নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নটির উত্তরের অপশনে দেওয়া হয়েছে - ক) পবিত্র কুরআন শরিফ, খ) পবিত্র বাইবেল, গ) পবিত্র ইঞ্জিল, ঘ) গীতা। কতটা হীন সাম্প্রদায়িক হলে এমন প্রশ্ন করা যায়। আবার ৪১ নম্বর ক্রমিকের প্রশ্নে বলা হয়েছে- ‘মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে?’ (ক) ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ (খ) ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, (গ) ২৫, সেপ্টেম্বর ২০১৭ এবং (ঘ) ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭। এই প্রশ্নে যে অপশন দেওয়া হয়েছে তার একটিও সঠিক উত্তর না।
কিন্তু এই যে এমন প্রশ্ন, যার সাম্প্রদায়িক ধরনের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদেরই জানার সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আরো প্রশ্নবিদ্ধ। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ‘দুটি প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সবাইকে ওই দুটি প্রশ্নের নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে।’ যেন নম্বর দিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
কথায় কথায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করা হয় যে সেখানে শুধু সনদ বাণিজ্য হয়, শিক্ষাদান হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব কাহিনী আবিষ্কৃত হচ্ছে তাতে বলা যায় অনেক শিক্ষক নিজেরাই ফেল করতে শুরু করেছেন, শিক্ষার্থীদের পাস করাবেন কী করে?
উচ্চশিক্ষার মান কী ও কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে তর্ক অনেক। উৎকর্ষ বলতে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত আছে সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাল আমলের আনিসুজ্জামানের। কিন্তু শিক্ষার মান কী করে উন্নত করা যায়, এ অঙ্ক সত্যিই কঠিন। মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সবার আগে যেটা করত হবে, কোনো রকম আপস না করে ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলার অভ্যাস করতে হবে এবং এখানেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের চারুকলার ভর্তি পরীক্ষাকে নজির হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। এসব শিক্ষককে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। খুঁজে বের করা প্রয়োজন এরা প্রথম শ্রেণি কি করে পেল, চাকরিই বা কী করে করছে এমন মান নিয়ে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রায় একই রকম। সাধারণত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সহিদুজ্জামানের একটা লেখা পড়েছিলাম একটি দৈনিকে সেখানে তিনি বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির কোনো ক্ষেত্র নয়; এটি শিক্ষা ও গবেষণার জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে চাকরির বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ। কিন্তু বাড়ছে না শিক্ষার গুণগত মান এবং তৈরি হচ্ছে না দক্ষ ও যুগোপযোগী গ্র্যাজুয়েট। গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা লেজে-গোবরে।’
ভালো মানের শিক্ষক কাকে বলব? শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সহজাত ক্ষমতার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থা তাকে তার বিষয়ের মূল নীতিগুলো সহজে বুঝিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। শিক্ষকের কাছে আশা এই যে, যে জ্ঞান আগে অর্জিত হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সম্যক ধারণা দেওয়া। শিক্ষকের ভূমিকাটা তাই একটু জটিল। তিনি হয়তো নিজের গবেষণা দিয়ে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে কিছু সংযোজন করেন না, কিন্তু ছাত্রছাত্রীর মধ্যে যথাযথ জ্ঞান সঞ্চার করে তাদের এগিয়ে যেতে, নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে সাহায্য করেন। শিক্ষক নিজে উঁচু মানের হবেন, ছাত্রছাত্রীর মধ্যে উঁচু মানের জ্ঞান বিতরণ করবেন, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভর্তি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জাতির সামনে নিয়ে এসেছে, এই যদি শিক্ষকদের দশা, তাহলে কেমন স্নাতক তৈরি করেন তাঁরা?
শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ একটি বড় বিষয়। ভালো পরিবেশ সব সময় ভালো ফল দেয়। বাংলাদেশর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একসময় এই পরিবেশটা ছিল। কিন্তু এখন নেই। শিক্ষক রাজনীতির কদর্য রূপ শিক্ষাকে, গবেষণাকে বিসর্জন দিয়ে দলাদলিকেই প্রথিতযশা হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে মেনে নিয়েছে বড় একটা অংশ। অধ্যাপকরা পড়াবেন তাঁদের ক্ষমতা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা পড়বে তাদের সাধ্যমতো। ক্যাম্পাস তৈরি করবে একটা পরিবেশ যাতে কিনা ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা বাড়ে। দলাদলির তীব্রতায় যোগ্য শিক্ষকের চেয়ে বেশি নিয়োগ হয় এখন যোগ্য ভোটার।
একটি মঞ্জুরি কমিশন আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আছে যাচ্ছেতাই করার জন্য ১৯৭৩ সালের একটি অধ্যাদেশ। আমাদের অনেক ভবন আছে, বেতনকড়ি, সুযোগ-সুবিধাও উন্নতির দিকে। কিন্তু যা নেই তা হলো শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাঠামো, গবেষণার পরিবেশের উন্নতির কোনো ভাবনা। শিক্ষকসমাজের মধ্যে পদ-পদবিমুখী মানসিকতা প্রোথিত করা হয়েছে এমনভাবে যে, তাঁরা শিক্ষার মান বিষয়ে ততখানি গভীর ভাবনায় থাকেন না, যতখানি থাকেন নিজস্ব প্রসন্নতা নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের সমন্বিত কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানও সমান নয় এবং ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈষম্য বিরাজমান। এ বৈষম্য দূর করতে ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে নীতিমালা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায়। উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানো ও সমুন্নত রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের একটি খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে শোনা গিয়েছিল। এই নীতিমালা হলে শিক্ষক নিয়োগের বাণিজ্য, দৌরাত্ম্য, পদোন্নতি জটিলতা, লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব কমাসহ শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে। শিক্ষার মান বজায় রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা নিতেই হবে। এটা করতে পারলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান উন্নত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যও দূর হবে। তবে সবার আগে মনের শুদ্ধতা দরকার। মনে রাখতে হবে প্রকৃত শিক্ষাবিদ, নিজের ইচ্ছায় উচ্চশিক্ষিত যেসব জ্ঞানী-গবেষক, যাঁরা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন বুঝবে, তাঁদের হাতে শিক্ষার গুণগত মান কখনোই মার খাবে না।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি
(এনটিভি অনলাইন থেকে সংগৃহীত)