৬ দফা বাঙালির মুক্তি সনদ

ড. আতিউর রহমান :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেশ কয়েকটি বাঁক বদল লক্ষ করা যায়। যে বাঁক বদলগুলো শুধু তার নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির ভাগ্যকেই আগাগোড়া পাল্টে দিয়েছিল। এর একটি যদি হয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, আরেকটি নিঃসন্দেহে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। ৭ মার্চের ভাষণকে যেমন ধরা হয় স্বাধীনতার মৌল আকাক্সক্ষার প্রকাশ, তেমনি ৬ দফাকেই মনে করা হয় বাঙালির মুক্তি সনদ।
১৯৪৯ সাল থেকেই বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছে। নিজের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে লড়াই করতে করতে ইতোমধ্যে দেড় দশক পার হয়ে গেছে। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বহু জেলজুলুম। এর মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তের জের ধরে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ১৭ দিন স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকিস্তান বিশালসংখ্যক সৈন্যের সঙ্গে নিজেদের কিছু ভূখ-ও হারায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে ২০ সেপ্টেম্বর দুদেশ যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। এ যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। উৎকণ্ঠিত শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে বোঝান, পূর্ববাংলার মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে পাকিস্তান সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই। ঠিক যেমন মাথাব্যথা নেই পূর্ববাংলার মানুষের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়েও। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শেখ মুজিব বাঙালির অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা জনসভায় এবং গণপরিষদে তুলে ধরছিলেন। এজন্য তাকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির পাঁচ মাস পরেই, ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমদিনেই শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফা দাবি পেশ করেন। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে লিখেছেন, ‘কিন্তু সভায় তা গৃহীত হয়নি। পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ফরিদ আহমেদসহ অনেকে আপত্তি করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের ৬ দফা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। (ভাস্কর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০০১, পৃষ্ঠা-১৮৯)।
লাহোরের সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রাথমিকভাবে যে ৬ দফা উত্থাপন করেন তা ছিল সংক্ষিপ্ত, প্রস্তাব আকারে। এগুলো ছিল :
১. শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিষ্ঠা যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ;
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অবশিষ্ট বিষয়গুলো ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে;
৩. দুটি পরস্পর বিনিময়যোগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ একটি মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহ রোধের শাসনতান্ত্রিক বিধান। ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর জন্য পৃথক রাজস্ব ও অর্থনীতি থাকবে;
৪. করারোপ ও লেভি বলবৎ করার বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে, কেন্দ্রের হাতে নয়, কেন্দ্রে যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় তহবিলের জন্য প্রদেশগুলোর কাছ থেকে সব কর রাজস্বের একটা অংশ পায় তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে;
৫. প্রতিটি প্রদেশের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি করে পৃথক হিসাব খোলা হবে এবং তারা প্রত্যেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তার ওপর তাদের নিজ নিজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আর এর একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির আন্তঃপ্রদেশ চলাচল ও পরিবহনের বেলায় শুল্কমুক্ত সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। প্রদেশগুলোর বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানোর এবং সংশ্লিষ্ট প্রদেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকতে হবে;
৬. প্রদেশগুলোর জন্য আধাসামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকতে হবে।
(তথ্যসূত্র : মোনায়েম সরকার সম্পাদিত, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি’, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ-২০০৮, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা-৩২২-৩২৩)।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে এসে সাংবাদিকদের কাছে ৬ দফা তুলে ধরেন। এর পর পরই তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে ছয় দফার মর্মবাণী ব্যাখ্যা করেন। ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৬ দফা অনুমোদিত হয়। এর কিছুদিন পরই ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের পরবর্তী রাজনৈতিক তৎপরতা মূলত এগিয়ে যায় ৬ দফার ওপর ভিত্তি করেই। ৬ দফার মূল বিষয় ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি।
ছয় দফা বঞ্চিত বাঙালির মনে আশার আলো জ্বেলে দিল। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করা হয়, তাতে অনেক প্রতিবাদী শ্রমিক ও আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। আহত হন অসংখ্য। আর জেলে ভরা হয় অগণিত। এই সময়টায় শেখ মুজিব কারারুদ্ধ। তার লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে আমরা জানতে পারি ছয় দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন তাকে কীভাবে স্বদেশের মুক্তির প্রশ্নে আশাবাদী করে তুলেছিল। আন্দোলন যতই তীব্র হয় ততই তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের ওপর নেমে আসে জেলজুলুম। কিছুতেই বাঙালির রাজনৈতিক প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে শেখ মুজিবকে এক পর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে তাকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার ফন্দি আঁটে স্বৈরাচারী সরকার। এর পরের কলামেই এ নিয়ে লিখব। এই ষড়যন্ত্র মামলা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়। তাতে ওই মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। আর শেখ মুজিব তিন বছরের বেশি সময় জেলে বাস করে ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ তার পক্ষেই যেতে থাকে। আইয়ুব সরকারের পতন হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন এবং সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তিনি সাংবিধানিকভাবেই স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য ছয় দফার পক্ষে গণরায় নেওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নেন। জনগণকে ছয় দফা বোঝানো এবং সংবিধানে কী করে এই দফাগুলো যুক্ত করা যায় সে বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞদের মতামত নেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বাঙালি গভর্নর জনাব রশিদের মাধ্যমে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামকে খবর দেন এ বিষয়ে তার সঙ্গে কাজ করার জন্য। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার ‘বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ছয় দফা কর্মসূচির খসড়া প্রণয়নে বেশকিছু বিষয়ে যাচাই, ব্যাখ্যা ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনার প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া দফাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বাস্তবায়ন সহজ করার লক্ষ্যে এর সঙ্গে সম্পূরক কতগুলো বিষয় যুক্ত করা হয়। যতই আমরা ছয় দফা নিয়ে কাজ করতে থাকলাম, দেখা গেল যে, একটি একত্রীভূত দেশব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দফাগুলোকে খাপ খাওয়ানো মূল সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে।’ (নুরুল ইসলাম, ‘বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা’ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ২০০৭, পৃষ্ঠা-৬৫)। এ সমস্যা সমাধানে নির্বাচন-উত্তর সময়েও তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করছিলেন। এরই এক পর্যায়ে জাতীয় পরিষদের ঘোষিত সভা স্থগিত করে দেন ইয়াহিয়া খান। আর তার পর পরই শুরু হয় ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন।
৬ দফার স্পষ্ট অর্থ আর কোনো আপস নয়, পাকিস্তান থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নতাই। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন, ১৯৪০ সালে এই লাহোরে একে ফজলুল হক দিয়েছিলেন লাহোর প্রস্তাব। যার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের। আর ৬ দফার ভিত্তিতেই মূলত প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘শেখ যদি নিবৃত্ত হতেন, যদি ছয় দফা না দিতেন তা হলে তিনি অত বড় নেতা হতেন না; আর পাঁচজনের একজন হয়ে থাকতেন। পাঁচজনকে ছাড়িয়ে অতিরিক্ত একজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না।’ (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা’ জাগৃতি প্রকাশনী, প্রথম জাগৃতি সংস্করণ ২০১৪, পৃষ্ঠা-১৩)। আমরা আগের লেখাগুলো থেকে জেনেছি ৬ দফা ঘোষণার পর থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চলতে থাকে একের পর এক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভয়ঙ্করভাবে ক্ষেপে ওঠেন। তিনি এটাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখেন। আইয়ুবের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমান জেলায় জেলায় সফর করেন এবং ৬ দফা বাস্তবায়নের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা, মহকুমায় সভা ও পথসভা করেন। ৬ দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমান ৭ এপ্রিল পাবনা, ৮ এপ্রিল বগুড়া, ৯ এপ্রিল রংপুর, ১০ এপ্রিল দিনাজপুর, ১১ এপ্রিল রাজশাহী, ১৩ এপ্রিল ফরিদপুর, ১৫ এপ্রিল কুষ্টিয়া, ১৬ এপ্রিল যশোর, ১৭ এপ্রিল খুলনায় বক্তৃতা করেন। ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেওয়ার জন্য ১৯ এপ্রিল শেখ মুজিবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। যশোর এসডিও কোর্ট তাকে জামিনে মুক্তি দেয়। তিনি যশোর, মাগুরার জনসভা শেষে ঢাকায় চলে আসেন। ২২ এপ্রিল ঢাকার এসডিও কোর্টে জামিনের আবেদন করলে তা বাতিল করা হয়। আদালতে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করেন। বিকালে ৫১ পুরানা পল্টনে কর্মিসভা শেষ করে ধানম-ির বাসভবনে ফিরে আসেন। তিনি যখন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেতে বসেছেন সে মুহূর্তে পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে সিলেট নিয়ে যায়। সিলেটের জনসভায় রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে সরকার মামলা দায়ের করে। তাকে সিলেট জেলে আটক রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল তাকে কোর্টে হাজিরা করা হয়। হাজার হাজার মানুষ কোর্ট প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। আড়াই ঘণ্টা তর্ক-বিতর্কের পর দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করেন। জেলগেটে লক্ষাধিক লোক। জেল থেকে মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার ওয়ারেন্ট নিয়ে পুলিশ সুপার হাজির।’ (সিরাজ উদ্দীন খান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২০৫-২০৬)
২০ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা সম্পর্কে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি ময়মনসিংহ জেলে। তার অনুপস্থিতিতেই বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিলের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ‘শেখ সাহেবকে ময়মনসিংহের কারাগারে রাখিয়াই এই দিন পল্টন ময়দানে সভার কাজ শুরু করা হয়। নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ায় পূর্ব ঘোষণানুযায়ী ঠিক ৪টায়ই সভার কাজ শুরু হয়। সভায় প্রধান বক্তা ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হয়রানির প্রতিবাদে ও তাহার প্রতি সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ পল্টন ময়দানের এই দিনকার এই মহতী জনসভায় সভাপতির আসন শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হইলে শ্রোতাম-লী এই সিদ্ধান্তকে তুমুল করতালির মধ্যে বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেন।’ (সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু, তৃতীয় খ-, ষাটের দশক, দ্বিতীয় পর্ব, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রথম প্রকাশ জুন ২০১৭, পৃষ্ঠা-৪৩৭)
শেখ মুজিব ২৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা আদালত থেকে মুক্তি লাভ করেন। ২৯ এপ্রিল কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণদানকালে শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘৬ দফাই প্রদেশবাসীর একমাত্র মুক্তি সনদ। তাহাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জন করতে হইলে ৬ দফার বাস্তবায়নের দ্বারাই তাহা সম্ভবপর হইবে।‘ (সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৬১)
৬ দফা আন্দোলনের সর্ববৃহৎ সভা অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জে, ১৯৬৬ সালের ৮ মে। লাখ লাখ মানুষ সমাগম হয় এদিন। মিছিলের পর মিছিল। জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে উপহার দেওয়া হয় ৬ দফার প্রতীক স্বর্ণপদক। ৬ দফার জন্য আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয় ৬টি পায়রা। রাতে বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন। জেগেই ছিলেন। শুনলেন পুলিশ এসেছে। গিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সে রাতে এবং পরদিন গ্রেপ্তার হলেন আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা। শুরু হলো শেখ মুজিবুর রহমানের আরও এক দীর্ঘ জেলজীবন। আর আগেই যেমনটি বলেছি, জেলে থাকা অবস্থাতেই তাকে জড়ানো হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। (চলবে)
আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক