ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার এর প্রকাশ্যে গণশুনানী; শিক্ষায় আলোকিত হবে মিতু-নাহিদের জীবন
তিন বেলা পেট ভরে খাবার পায় না ৬ বছরের মিতু আর ৪ বছরের নাহিদ। মায়ের পিছনে পিছনে ঘুরে দিনের কোন বেলায় আধপেট আবার কোন বেলায় উপোষ ই কাটাতে হয়। আর খাবার পাবেই কিভাবে, ওদের মা পলাশী বেগম এর ওর বাড়ি কাজ করে, যা পায় তা দিয়ে তিন বেলার আহার জোটানো কষ্ঠ সাধ্য। খাবার প্রাপ্তিই যেখানে কষ্ঠসাধ্য সেখানে পোষাকের কথা দুঃসাধ্য। আর শিক্ষা? সেটা ওদের জন্য সুদূর পরাহত। যেখানে খাবার জোগানোর সামর্থ নাই, পোষাক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নাই, সেখানে শিক্ষার ব্যবস্থা কে ই বা করবে ওদের। এমন নানাবিধ মৌল মানবিক অভাবের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত হচ্ছিল ওদের।
ঠিক এমনই একটা সময় ওরা সন্ধান পায় ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের। লোক মাধ্যমে শুনতে পায় জেলা প্রশাসক অতুল সরকার সাধারণ মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকেন। তবে সপ্তাহের বুধবার দিন বেশি সময় নিয়ে তিনি সাধারণের কথা শুনেন। শোনা কথায় বিশ্বাস করে পলাশী বেগম ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের পিয়াজখালী এলাকার চাকলাদার গ্রাম থেকে ছুটে আসেন জেলা প্রশাসকের দ্বারে। পৌছতে পৌছতে অনেকটা বেলা গড়িয়ে যায়।
পলাশী বেগম দেখেন অফিসের দো-তলায় ফাকা জায়গায় অনেক লোক। কেউ বা বসে আছে চেয়ারে, কেউবা দাড়িয়ে। সকলের সামনে একজন লোক বসা। পলাশী ওখানকার একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভাই, এ অফিসে ডিসি কিরা?’ লোকটা তাকে দেখিয়ে দেয়, লোকজনের সামনে বসে থাকা লোকটাকে। এগিয়ে যান পলাশী। দেখেন তার সামনে একেএকে লোকজন তাদের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। একজন বয়স্ক ব্যক্তির থাকার ঘর না থাকার কথা জানালেন। সাথে সাথে তার নিজের কোন জমিজমাও নাই, জানালেন। জেলা প্রশাসক তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন দিয়ে যাচাইপূর্বক তাকে আশ্রয় কেন্দ্রে ১ টি ঘর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। অন্য ব্যক্তি এসেছেন তার বাড়িতে বার্ষিক উরশ হবে তার অনুমোদন ও কিছু অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য।

পলাশী বেগম নতুন এসেছেন। তাই অনেকটা ইতস্তত করছিল তার মনটা। কিভাবে কথা বলবেন। আরও একটু ধৈর্য ধরে দেখতে থাকলেন কে কি বলে। দেখলেন, এক ব্যক্তি ভাল পোষাক পড়া, সে তার বাড়ির জমি জমা নিয়ে প্রতিবেশির সাথে ঝামেলার কথা জানালো। জেলা প্রশাসক সাথে সাথে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বললেন। অন্য একজন মুরুব্বী টাইপের মহিলা জানালেন তার বাড়িতে ঘর নাই। এক চিলতে ছনের ঘর ছিল। বহু বছরের পুরাতন। এখন সে ঘর দিয়ে পানি পড়ে। তার ঘর দরকার। জেলা প্রশাসক তাকে সরকারি টিন প্রদানের জন্য জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন।
বাড়ির পাশে কিছু ছেলে পেলে রাত অবধি আড্ডা দেয়, একজনের অভিযোগ পেয়ে সেখানে আইনগত সহায়তার পরামর্শ দিলেন জেলা প্রশাসক। জেলা সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের দশম শ্রেনির ছাত্রী চাদঁনী আক্তার। গত কয়েক মাস যাবত স্কুলের বেতন ও প্রাইভেট পড়ানোর বেতন দিতে পারছিলেন না। জেলা প্রশাসক ধৈর্য ধরে তার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাকে নগদ অর্থ সাহায্য ছাড়াও তার পড়াশুনার খরচ বহন করার কথা জানান।

এবার পলাশী বেগম অনেক টা সাহস সঞ্চার করে নিজের সমস্যার কথাটা জানালেন। জানালেন, ৮/৯ বছর আগে সদরপুর উপজেলার আটরশি স্ট্যান্ডের পাশে রব মাতুব্বরের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের এক সন্তান হয়। নাম রাখে মিতু। কিছুদির পর থেকে স্বামীর আচরণ বদলে যায়। কারনে অকারনে তাকে মারধর করতে থাকে। এ সময় পলাশী জানতে পারে তার স্বামী আগেও একটা বিয়ে করেছিল। তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। এখন আবার তাকে নিয়ে সংসার করবে। এক সময় পলাশীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কয়েক বছর পরে আবার আগের বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। এ সময় পলাশীকে আবার ঘরে তুলে, তাদের এবার একটি পুত্র সন্তান হয়। নাম রাখে নাহিদ। কিছুদিন পরে আবার তার স্বামী পূর্বের বউকে নিয়ে আসে। ওদের বাড়ি থেকে আবার তাড়ায়। এবার পলাশী পড়ে মহা বিপদে। একটি মেয়ে একটি ছেলে নিয়ে কিভাবে বাচবে? মানুষের বাড়িতে কাজ করা শুরু করে। নিজেতো নয়ই বাচ্চাদেরও কোন দিন পেট পুড়ে খেতে দিতে পারে না। পলাশীর মেয়ের বয়সী সবাই স্কুলে গেলেও তার মেয়ে মিতুকে স্কুলে দিতে পারেনি। ছোট ছেলেটা এখনো স্কুলে যাবার বয়স হয়নি।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার মন দিয়ে তার কথা শুনেন। মেয়ে মিতু (৭)কে সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা)তে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ছেলে নাহিদের (৪) বয়স হলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবেন। এই দু জনের পড়ালেখার জন্য তিনি নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে যেকোন প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একই সাথে ওদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে দেন।
পলাশী বেগম বলেন, আল্লা আমারে বাচাইছে। ডিসি স্যার সব দায়িত্ব নিছে। এখন খাই না খাই পোলাপানের নিয়ে আর কোন চিন্তা নাই। আল্লা ডিসিরে হায়াত দিক; দোয়া করি।
প্রকাশ্যে গণশুনানীর আয়োজনের মাধ্যমে শুধু পলাশী বেগমই নয় বদলে যাচ্ছে হাজরো মানুষের জীবন। গড়ে উঠছে সম্ভাবনা। পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের। সমাধান হচ্ছে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার।
প্রকাশ্যে গণশুনানীর বিষয়ে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, একটা সময় অফিস কক্ষে গণশুনানী অনুষ্ঠিত হত। এ শুনানীতে জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা রকমের লোকজন আসতেন। এদের কেউ অল্প বয়সী, কেউ বয়ষ্ক। তিনি জানান, অফিস কক্ষের মধ্যে ছিমছাম পরিবেশে অনেকেই কথা বলতে সংকোচ করতেন, কেউ কেউ তাদের সকল সমস্যা খুলে বলতে পারতেন না। এখন প্রকাশ্যে গণশুনানীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে সংকোচটা আর থাকছে না। সকলে তাদের মনের কথা খুলে বলছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে গণশুনানীতে প্রায় ৫ হাজার জন সেবা প্রত্যাশী জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে এই চলমান মাসে প্রায় ৪৫৩ জন, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৪২৭ জন সেবা প্রত্যাশী সাক্ষাৎ করেন। আগস্ট মাসে ৩৫২ জন; জুলাই মাসে ১৪২ জন সেবা প্রত্যাশী সাক্ষাৎ করেন।
মূলতঃ জমির একসনা বন্দোবস্ত প্রাপ্তি, আইনগত সহায়তা, আর্থিক সাহায্য, টিআর, জিআর. সরকারি ডেউটিন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রাপ্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তি, বিধবা ভাতা প্রাপ্তি, বাল্য বিবাহ রোধ, জমিজমা বিরোধ সংক্রান্ত, ঘর মেরামত , পড়ালেখার খরচ চালানো, শীতের পোষাক প্রাপ্তি, ধর্মীয় কার্যাদিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলার নাগরিকগন জেলা প্রশাসকেককে জানান। জেলা প্রশাসক সেসব সমস্যা সমাধান করে থাকেন। সাধারণত প্রতিদিনই জেলা প্রশাসক জনসাধারণের কথা শুনে থাকেন। তবে বিশেষভাবে প্রতিবুধবার দীর্ঘ সময় নিয়ে গণশুনানী অনুষ্ঠিত হয়।
