চিকিৎসা সেবায় অনুদান নিয়ে এগিয়ে আসুন: বিত্তবানদের প্রধানমন্ত্রী

চিকিৎসকদের ‘সেবার মনোভাব নিয়ে’ মানুষের পাশে থাকার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “বিত্তবানদের সংখ্যা বাড়ছে। এই অর্থ-সম্পদ নিজের কাছে না রেখে চিকিৎসা সেবায় যথেষ্ট অনুদান দিতে পারেন। নিজের নামে একটা ওয়ার্ড করে দিতে পারেন, অ্যাম্বুলেন্স দিতে পারেন। লাইব্রেরিটা উন্নত করে দিতে পারেন।”
বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস- এর ত্রয়োদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান আসে।
চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “একজন ডাক্তারের ওষুধের থেকে মুখের কথায় অর্ধেক অসুখ ভালো হয়ে যায়। আমরা তো রুগী হই মাঝে মাঝে, আমরা বুঝি।
“এই কথাটা মনে রেখে আপনাদের এই মহৎ পেশাটা সততার সাথে করবেন, মানুষকে সেবা করার মনোভাব নিয়ে কাজ করবেন।”
রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে বুধবার এই অনুষ্ঠানে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের জীবনে এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
“একটি মহৎ পেশায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে যাচ্ছেন। মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে মানুষের কল্যাণে আপনারা কাজ করবেন।”
আজকের নবীন চিকিৎসকদের সামনে বক্তব্য দিতে এসে ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তখনকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করেন তার বড় মেয়ে হাসিনা।
“তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা ডাক্তার। আপনাদের মন হতে হবে, অনেক উদার। আপনাদের মন হবে সেবার। আপনাদের কাছে বড়-ছোট থাকবে না। আপনাদের কাছে (বিবেচ্য) থাকবে রোগ। কার রোগ কত বেশি, কার রোগ কম। তাহলেই তো সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে এবং মানুষের মনে আপনাদের জন্য সহযোগিতা বাড়বে’।”
জাতির পিতার সেই কথাগুলো ‘স্মরণ রাখার’ আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সব থেকে মেধাবী যারা, তারাই তো মেডিকেলে পড়তে যায়। মেধাবীরা তাদের মেধা দিয়ে, আমরা দেশটাকে কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাব, সেই সহযোগিতাটা করবেন।”
জনসংখ্যার তুলনায় দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা কম হওয়ার যে জটিলতা তৈরি হয়, সে কথাও অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।
“১৬ কোটি মানুষের দেশ। সে তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা অত্যন্ত কম, নার্সের সংখ্যা আরও কম। এ রকম একটা পরিবেশে মন-মানসিকতা ঠিক রেখে চিকিৎসা দেওয়া... প্রচণ্ড একটা প্রেশার থাকে, সেটা আমরা বুঝতে পারি।”
তারপরও চিকিৎসকরা তাদের মানবিক গুণাবলী দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু রাজধানীতে নয়, বিভাগীয় শহরগুলোতেও বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হবে।
“তারপর জেলায় চলে যেতে হবে। আমাদের জনসংখ্যাটা মাথায় রাখতে হবে। আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।”
তিনি বলেন, “প্রত্যেক মানুষ যাতে চিকিৎসা পায়, সে ব্যবস্থা আমরা করতে চাই। তাই এক কেন্দ্রীক না করে, এটাকে ডি-সেন্ট্রালাইজড করে দিতে চাই। যাতে মানুষ ঘরে বসে চিকিৎসা পেতে পারে।”
নারীদের সুবিধার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কম-বেশি প্রতি ছয় হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ‘মেয়েরা হেঁটে গিয়ে’ চিকিৎসা নিতে পারে।
প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
“আমাদের আর্মির যে ডেভিশনগুলো আছে, ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি, সেখানে একটি করে মেডিকেল কলেজ এবং নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।”
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবারের ফেলোদের হাতে সনদ ও সোনার পদক তুলে দেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির জন্য ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে গত সাত বছরে নতুন চিকিৎসক নিয়োগ এবং বিদেশে পাঠিয়ে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন। অপুষ্টিরোধে ডিটামিন ও ফলিক এসিড বিতরণ এবং শিশুদের কৃমির ওষুধ খাওয়ানোর কথা বলেন।
অটিস্টিকদের সহায়তায় নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে যতটা সচেতন ছিলাম, অটিস্টিকদের বিষয়ে ততটা ছিলাম না। অনেক বাবা-মা অটিস্টিক বাচ্চা থাকলে তাদের লুকিয়ে রাখত। মানুষের সামনে বের করত না। তারা লজ্জা পেত। মনে করত, এটা সামাজিক লজ্জা।
“এই অটিস্টিক শিশুরা স্কুলে গেলে, তার সাথীরা যেমন ঠাট্টা করতো, আবার শিক্ষকরাও অত্যাচার করত।... আমরা অনেক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি।”
অস্টিজমের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে নিজের মেয়ে সায়মা হোসেনের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি গর্বের সঙ্গে বলব, আমরা মেয়ে সায়মা... ও যেহেতু চাইন্ড সাইকোলজিস্ট হিসাবে ডিগ্রি নিয়েছে, আমি এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে জানতে পারি।”
তিনি বিদেশ থেকে সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করার কথা বলেন এবং নিজেদের কাজ নিজেরা করার পরিকল্পনা থেকে দেশ পরিচালনা করার কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, “আমরা খাদ্য নিরাপত্ত নিশ্চিত করতে পেরেছি বলেই গড় আয়ু ৭১ হয়ে গেছে। আমার এখন ৭০ বছর। আমার হাতে মোটে এক বছর আছে।”
বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস- এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এস এ এম গোলাম কিবরিয়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
কলেজের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
কলেজের সহ-সভাপতি অধ্যাপক রুহুল আমিন অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।