হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটি: পাল্টা কমিটির প্রস্তুতি শফীপন্থিদের

বর্তমান গ্রেফতার অভিযান ও প্রতিকুল পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। হেফাজতের নতুন আহ্বায়ক কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হলেন আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, আহ্বায়ক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, সদস্য আল্লামা সালাউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। এদিকে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমীর আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীরা পাল্টা কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এদিকে হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির ও বর্তমান আহ্বায়ক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
রবিবার রাত দুইটায় প্রথমে তিন সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর দুই ঘন্টা পর রাত পৌনে ৪টার দিকে সদ্যঘোষিত হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী তার ফেসবুক পেজে লাইভে এসে আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য হিসেবে আল্লামা মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মাওলানা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানান। এর আগে রবিবার রাত ১১টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে হেফাজতের প্রাক্তণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন আল্লামা বাবুনগরী। গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। ওই সংঘাতে প্রাণ হারান অন্তত: ২০ জন। সেসব ঘটনায় একাধিক মামলা হয়। মামলার আসামিদের ধরতে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ পর্যন্ত হেফাজতের অন্তত এক ডজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কোণঠাসা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই সমঝোতার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত সপ্তাহে হেফাজত ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসায় দেখা করে দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত বর্তমান কমিটি ভেঙে নতুন আহবায়ক কমিটি করলেন হেফাজত নেতারা।
নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীরা পাল্টা কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটি নেতৃত্ব নিয়ে নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আল্লামা শফীর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি গতকাল বলেন, মূল কমিটি বিলুপ্ত করে পাঁচ জনের যে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে তা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব তার আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে যে কমিটি করেছেন তাকে হেফাজতের কমিটি না বলে পারিবারিক কমিটি বলাই ভালো। এই কমিটি দেশ, জাতি, আলেমসমাজ কিংবা হেফাজতে ইসলামের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই আমরা যোগ্য নেতৃত্বের সমন্বয়ে নতুন কমিটি করার চিন্তাভাবনা করছি।
কারা এই কমিটিতে থাকবেন জানতে চাইলে মাওলানা রুহী বলেন, আল্লামা শফী সাহেব তার ইন্তেকালের কয়েক মাস আগে ২০১ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করেছিলেন। ওই কমিটিতে আল্লামা শফী ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম যথাক্রমে আমীর ও মহাসচিব হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল। বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর এই কমিটির ব্যাপারে সম্মতিও ছিল। প্রস্তাবিত কমিটিতে আল্লামা শফীসহ কয়েকজন ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন। এরকম কয়েকজনের নাম সংযোজন বা বিয়োজন করে ওই কমিটিই বলবত্ রাখা হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে মিডিয়ায় ঘোষণা আসবে।
এ ব্যাপারে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে তার ব্যক্তিগত সহকারি বলেন, হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল। তাই এর আগে যদি কমিটি হয়েও থাকে তার আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির ও বর্তমান আহ্বায়ক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এ মামলা দুটি হয়েছে। এ দুই মামলাসহ ওই ঘটনায় মোট তিনটি মামলা করা হলো। এসব মামলার অন্য আসামির মধ্যে আছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, উপজেলা জামায়াতের আমিরসহ তিন হাজার ব্যক্তি। মামলা তিনটি গত বৃহস্পতিবার হাটহাজারী থানায় দায়ের করা হলেও গতকাল সোমবার জানা গেছে।
সূত্র জানায়,একটি মামলার বাদী চট্টগ্রাম পুলিশের জেলা বিশেষ শাখার (ডিএসবি) কনস্টেবল মো. সোলায়মান। এ মামলায় বাবুনগরী, হেফাজত নেতা মীর ইদ্রিস, নাছির উদ্দিন, জাকারিয়া নোমান, আহসান উল্লাহসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আরেক মামলার বাদী হাটহাজারী থানার পরিদর্শক আমির হোসেন। এ মামলায় জুনায়েদ বাবুনগরী, হেফাজত নেতা জাকারিয়া নোমানসহ উপজেলা জামায়াতের আমিরসহ ৭৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার জন। অন্যদিকে হাটহাজারী থানার এসআই হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে তৃতীয় মামলাটি করেছেন। এ মামলায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সৈয়দ ইকবাল, উপজেলা হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমরান শিকদারসহ ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ২৫০-৩০০ জন।