অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী

গত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শুরু করে এপ্রিল ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মহামারি করোনার কারণে অগোছালো হয়ে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। ফলে,পড়ালেখা থেকে পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে পাঠদানের সাথে বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। এর সঙ্গে থমকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমও। তবে,এসবের মাঝেও শিক্ষা-কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইন ও দূর-শিক্ষণ পদ্ধতির পাঠদান চলছে। অভ্যন্তরীণ ভাবে অনলাইনে কিছু কিছু স্কুল-কলেজের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু, এতে করেও শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য সত্যিকার অর্থে পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, "করোনায় শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক ও সবচেয়ে বেশি। এই সমস্যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি বলে দাবি করছেন তাঁরা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকেরাও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শিকার। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবীণ শিক্ষকরা বলেন, " শিক্ষা পুনরুদ্ধার এসময়ে সবচেয়ে প্রধান বিষয়। কিন্তু, যা চলে গেছে, তা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বরং এখন এই সমস্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে, অন্য দেশের ন্যায় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নিজস্ব প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু, একসাথে যদি সকল প্রতিষ্ঠান খুলতে পারা না যায়,সেক্ষেত্রে যেখানে পরিস্থিতি উন্নত হবে,সেখানে আগে খুলে দিলে ব্যাপারটা শিথিল হবে। আর এটাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে।"
দেশে গতবছরের ৮ মার্চে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এবছর ৩০ মার্চ প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২২ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের জন্য অনলাইন ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠদান পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলেও, এতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থীদের কাছে তা পৌঁছাচ্ছে না। যেহেতু, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়,সেহেতু এতে করে পার্বত্য ও আঞ্চলিক অঞ্চলগুলোতে উন্নতমানের ইন্টারনেট ব্যবস্থা না থাকায়, অনেক শিক্ষার্থী এসব কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছে। ফলে সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে তারা।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে)সমীক্ষা বলছে, "দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। ব্রাকের সমীক্ষা মতে,টেলিভিশন পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী-ই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের বাহিরে।
এদিকে,শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদিও বিপরীত বলছে,তারা বলছে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের অধীনে এসেছে। আর স্কুল-কলেজের মাধ্যমে এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ৮৫ শতাংশকে লেখাপড়ার সাথে সম্পৃক্ত করেছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা চৌধুরী বলেন, " করোনায় শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও সমাজের উপর নানান দিক হতে প্রভাব পড়তে পারে। এর অন্যতম - শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্য-বিবাহ এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। এই পাঁচটির প্রত্যকটি বেড়ে যেতে পারে। করোনার ফলে শিক্ষার্থীরা দুই কারণে স্কুল-কলেজে আর না-ও ফিরতে পারে। প্রথমত -দীর্ঘ শিখন বিরতির কারণে একটি পাঠ না পারা ও বোঝার পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। দ্বিতীয়টি- সম্ভাব্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিপীড়িত হয়ে বাবা-মায়ের সাথে জীবিকার তাগিদে নিজেকে নিয়োজিত করা। আর ঝরে পড়া মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে এটা মাধ্যমিকে ঝরে পড়াদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটতে পারে। এই বিষয়ের সাথে সন্তান জন্মদান ও মৃত্যুর সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এমনটি ঘটলে বহু কষ্টে অর্জিত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষা, নারী শিক্ষা ও মাতৃ-শিশু মৃত্যুতে যে অর্জন তা ম্লান হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেন, এটা ঠিক যে, করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্ষতি অপরিমেয়। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়,সারাবিশ্বের। প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব সুবিধা ও পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরণের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরাও করোনা পরিস্থিতির শুরুর থেকেই সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। দূরশিক্ষণ ও অনলাইন পদ্ধতিতে ইতিমধ্যে পাঠদান কার্যক্রম চলছে। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে খোঁজখবর রাখা, অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের সাথে চলমান রাখা, এমনকি তাদেরকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্যও কাজ করতে হচ্ছে। যার সুফলও দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরো বলেন,- অনলাইন "অ্যাকসেস"ভালো রয়েছে যেখানে, সেখানে সরাসরি পাঠদান " গ্যাপ" অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।
এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রি-টেস্ট বা টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেনি। দশম শ্রেণিতে তারা ক্লাস করেছে মাত্র দুই থেকে আড়াই মাস। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণিতে অটোপাশ নিয়ে উঠেছে। কিন্তু, এখন পর্যন্ত একদিনও দ্বাদশ শ্রেণিতে সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি। এ কারণে, সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে তাদের পরীক্ষা নেয়া হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বয়স ও স্তর অনুযায়ী জানার পরিসর কমে যেতে পারে। যদিও অন্য কথা বলছেন এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তিনি বলেছেন, বয়স এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, জ্ঞানগত দিক অক্ষুণ্ণ রেখেই এই সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে, করোনার আরেক বড় ক্ষতিগ্রস্ত খাত উচ্চশিক্ষা। শুরুর কিছুদিন পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে, প্রথম দিকে অনলাইন ক্লাস এবং পরে পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। সংক্রমণ কমার পর গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স বর্ষ/সেমিস্টার এবং মাস্টার্স পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি বাতিলের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝপথে বিভিন্ন বর্ষ/সেমিস্টারের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। আর আগের সেমিস্টার পরীক্ষা নিতে না পারায়,এখন অনলাইনে পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাসও স্থগিত আছে বলে জানা গেছে৷
এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতেও শত শত পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে করোনায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ থেকে দেড় বছরের সেশনজট তৈরি হয়েছে। আর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বন্ধ আছে গবেষণা কার্যক্রম।
(ফেরদৌস রহমান ,নারায়ণগঞ্জ)