শামসুজ্জামান খান: প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার সুস্পষ্ট ভেদরেখা

শামসুজ্জামান খান এর মৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মাসরুর আরেফিন এর ফেসবুক স্টাটাস
——
শামসুজ্জামান খান এভাবে হুট করে চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি। তিনি আমাকে এই সেদিনও বলেছিলেন যে, ‘তোমার নতুন উপন্যাস বের হওয়া মাত্র আমি যেন পাই।‘ আমি সেটাই তাঁর বাসায় পাঠালাম। যে লোক বাসায় গেল—যদিও জানি তিনি হাসপাতালে, তারপরও পাঠিয়ে রাখা; এমন স্বপ্ন নিয়ে যে, তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরেই দেখবেন আমি কথা রেখেছি—সেই লোক ফোন করে আমাকে জানাল, ‘এখানকার সবাই বলছে, জামান স্যার লাইফ সাপোর্টে চলে গেছেন।‘ আমি জানতাম তিনি অসুস্থ। তিনি হাসপাতালে যাবার ঠিক আগের দিন আমি তাকে ফোন করেছি, তিনি ধরেছেন, বলেছেন, ‘দোয়া রেখো।’
চলে গেলেন তিনি। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় মাত্র বছর দেড়েকের। দেড় বছর আগে তিনি আমার উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমাদের দেখা হয়েছে মোট চার কিম্বা পাঁচবার। আমার দুই উপন্যাসই—‘আগস্ট আবছায়া’ ও ‘আলথুসার’—তাঁর অনেক ভাল লেগেছিল। গত বছর অক্টোবর মাসে আমার জন্মদিনে আমার উপন্যাস নিয়ে এক প্রশংসাভরা রচনা লিখে তিনি আমাকে অবাক করে দেন। কিন্তু আজকের এ লেখা আমাকে নিয়ে না। এ লেখা তাকে নিয়ে।
আমি গত দেড় বছরে তাঁর লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ পড়েছি। তিনি আমাকে তাঁর অনেকগুলো বই উপহার দিয়েছেন। আগেও যে তাঁর দু-দশটা লেখা আমার জানা ও পড়া ছিল না, তা না। কিন্তু এই নতুন করে তাকে পড়ার মধ্যে দিয়ে জানলাম যে, আইডেন্টিটি পলিটিক্সের এ রক্তাক্ত সময়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ব্যাখ্যাটা দেবার জন্য তাঁর মতো অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন মনীষী আমাদের এই কালে আর একজনও ছিলেন না। শামসুজ্জামান খানের কারণেই আমি বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, এদেরকে নতুন চোখে দেখতে শিখেছি। তিনি বিশাল কোনো গবেষণাধর্মী কাজ শেষ করে যান নি সত্য, কেবল কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে লিখে গেছেন আমাদের জাতির উৎস, গতিমুখ, আমাদের সংস্কৃতির ধারা ও প্রবণতা এইসব নিয়ে, তাও সত্য, কিন্তু ওনার লেখা ওই বিক্ষিপ্ত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোই এতটা নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টিতে ভরা যে—আর সময়ের বিচারে আমাদের জন্য সে সব এখন এতটাই জরুরি যে—তাঁর কাছ থেকে আমরা কেন বিরাট সাইজের কোনো গবেষণাগ্রন্থ পেলাম না সেট নিয়ে অন্তত আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
আজ থেকে মাত্র পাঁচ শুক্রবার আগের কথা যে, স্যারের সঙ্গে ফোনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমার কথা হল। বলা উচিত একরকম বাদানুবাদই হয়ে গেল। বিষয় জয়া চ্যাটার্জির ‘বাঙলা ভাগ হল’ বইটা। স্যার আমাকে বলছিলেন, সপ্তম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে বাইরের থেকে আর্যরা—যেমন পারস্য, আফগানিস্তান ও তুরস্কের বণিক ও ধর্মপ্রচারকেরা—এখানে আসার পরে বাংলায় শুরু হয় প্রথম কোনো বড় মাপের সামাজিক পরিবর্তন। এর আগে ‘হিন্দু’ শাসনের যে-আমলটা ছিল, তখন এই বিশাল বাংলা বা বঙ্গ নামের জগাখিচুড়ি ভৌগলিক অঞ্চল একটা কোনো একক ধরনের সাংস্কৃতিক সত্তা বা পরিচয় অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু, স্যার বলতে লাগলেন, ওই আর্যদের আসার পরের ‘মুসলমান’ যুগেই আর্যদের প্রভাবে এই ভূখণ্ডে আমাদের আদিম ও সনাতন ‘শিফটিং‘ এগ্রিকালচার রূপ নেয় ‘সেটেলড্‘ এগ্রিকালচারে। আর্যরা ম্লেচ্ছদের সঙ্গে কৃষির কৃৎকৌশল বিনিময় করে নিম্নবর্গের মানুষকে ঘৃণা করার বদলে তাদেরকে সাথে নিয়ে এক স্থায়ী কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রবর্তন করে।
এ সময়েই স্যার বললেন ব্রাহ্মণদের প্রাধান্যের কারণে অস্পৃশ্যদের সমাজের বৃত্তের প্রায় বাইরে চলে যাবার কথা। আর তাঁর কাছ থেকে এ-পর্যায়েই আমি জানলাম ‘ধর্মনিরপেক্ষ‘ মানসিকতার তাঁর দেওয়া সংজ্ঞাটাকে। তিনি আমাকে বললেন—কৃষিসভ্যতা আমাদের এই অঞ্চলে বাইরে থেকে আসা লোক আর এখানকার পিছিয়ে থাকা মানুষকে এক করেছিল। প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছিল এক সংকর জনগোষ্ঠীর, যাতে যোগ হয়েছিল নানা মত ও পথের, দেশীয় ও বিদেশীয় ভাবনার, আর ওই সম্মিলন আবারও প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষকে করেছিল পরমতসহিষ্ণু, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বহুত্ববাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। এইটাই ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালির নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতা, যেটা ধরনে মানবপন্থী, লোকায়ত কারণেই ভাবুকতায় ভরা, ধর্মের অনুশাসনকে মেনে মানবিক বোধে ভরপুর। এটা পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতার উল্টো। ওদেরটা বিজ্ঞানমনস্কতা, গ্রিক গণতন্ত্রের ওপরে আস্থা ও শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমাদেরটা তেমন না। আমাদেরটা ম্যাটেরিয়ালিস্টিক সেকুলারিজম না। আমাদেরটা শুরু থেকেই জাতে মরমী।
স্যারের এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করার ইচ্ছা মনে জেগে উঠলেও আমি কিছু বললাম না, উল্টো তাঁর জেনারেশনের ‘ক্ল্যাসিক‘ ভাবধারার মানুষগুলোকে বোঝার চেষ্টা করলাম চুপচাপ। কিন্তু অন্যদিকে রিচার্ড ইটনের ‘The Rise of Islam & the Bengal Frontier’ বইয়ে যে বাংলায় সত্যিকারের বড় মাপের সামাজিক পরিবর্তন শুরুর সাল হিসেবে আছে ১২০৪ সালের কথা, সেটা তাঁকে মনে করিয়ে দিতে ভুললাম না। বললাম, ‘স্যার, আপনি বললেন সপ্তম শতাব্দীর কথা। তপন রায় চৌধুরীও বলছেন একই কথা। কিন্তু ইটন বলছেন তার পাঁচ শ বছর পরের কথা। তারিখ নিয়ে পাঁচ শ বছরের গোলমাল থাকলে সেই তারিখে-তারিখে ঘটা ঘটনাগুলোর অনুমানগুলো নিয়ে কত গোলমাল থাকতে পারে বলেন?’
স্যার স্পষ্টতই আমার কথায় কিছুটা আহত হলেন। কিন্তু রেগে ওঠা যেহেতু তাঁর স্বভাবে নেই, তাই তিনি একইরকম নরম গলায় আমাকে বললেন, ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস দুই-আড়াই হাজার বছরের পুরোনোও বলা হয়। আবার তুমি যে ইটনের বইয়ের কথা বলছ, সেখানে যে রাজগণেশের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে বাংলা ভাষার ব্যবহার রাজসভায়ও তুমুলভাবে চলছে, সেটাও তো ওই তারিখটা নিয়ে কোনো আন্দাজ দেয় নাকি?‘
আমি বুঝলাম স্যারের সঙ্গে আমি অন্তত এ বিষয়ে পারব না। শুধু অনেকটা কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, ‘স্যার, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তো বলেছিলেন যে, বাঙালির ইতিহাস পাঁচ শ বছরের ইতিহাস?‘
স্যার বললেন, ‘থাক, তোমার সঙ্গে দিন তারিখের বাহাস করে কী লাভ? আবদুর রাজ্জাকের কথাটা নিয়ে আমি লিখেছি, আবার বাংলা সন প্রবর্তনের সময় ধরে বিষয়টার একটা হিসাব পাবার চেষ্টা করেও আমি লিখেছি।‘
আমি স্যারকে জানালাম যে, আমি পড়েছি তাঁর সেই লেখা। বললাম ওটা নিয়েই তাকে আমি বলতে চাইছিলাম যে—তিনি লিখেছেন বাংলা সনকে আমরা ‘সন’-ও বলি, ‘সাল’-ও বলি। ‘সন’ আরবি শব্দ, ‘সাল’ ফারসি। তো আমরা যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে ‘সন’ বলা শুরু করলাম, তার মানে কোনো মুসলমান শাসক ওটার প্রচলন করেছিলেন, যে কারণে ‘তারিখ’ বলাও শুরু হল। অতএব বাংলা সন কোনো মুসলমান শাসকের সৃষ্টি এবং মুসলিম আমলেই, সম্ভবত মোঘল আমলেই, এর জন্ম।
আমি বললাম, ‘স্যার আপনার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। কারণ বাংলা বর্ষপঞ্জিকে বাংলা সন বা সাল বলা শুরু হওয়া মানে কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হওয়া না, কেবল অলরেডি চালু থাকা বর্ষপঞ্জির নামটা বদলে যাওয়া।‘ আর আরও বললাম যে, ‘ভারতে পড়ার কারণে আমি জানি আমাদের পহেলা বৈশাখ গুজরাটে-পাঞ্জাবে-উত্তরাখণ্ডেও পহেলা বৈশাখ। ওইটা হিন্দি সালেও পহেলা বৈশাখ, তামিল সালেও তাই।‘
স্যার বললেন, ‘মাসরুর, আমি খুশি যে, তুমি আমার লেখা বইটা মন দিয়ে পড়েছ। কিন্তু তুমি ইরানের "নওরোজ" দিল্লিতে চালু হওয়ার, নববর্ষের দিনে ইরানের "মিনা বাজার" দিল্লিতে চালু হওয়ার ইতিহাসটা যদি দেখো তো বুঝবে আমি কী বলেছি?’
আমি বুঝলাম, স্যার সুনীতিকুমারকে মাথায় রেখে এই কথা বললেন। কিন্তু সামনাসামনি বসা ছাড়া এই তর্কের যেহেতু শেষ নেই, যেহেতু মাঝখান থেকে আমার অল্পবিদ্যা নিয়ে এরকম বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে বোদ্ধা ও নিবিষ্ট একটা মানুষকে শুধু কষ্টই দেওয়া হবে, তাই আমি বিষয় বদলানোর প্রয়াস নিলাম। আর এমনিতেও আমাদের কথার বিষয় তো ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। তো, সেটাতে থাকাই তো ভাল।
আমি কথা অতএব সঠিক দিকে ঘোরানোর জন্যই স্যারকে বললাম, ‘স্যার আপনি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সুলতানি আমলে যে নতুন এক বাঙালি সত্তার শুরু, অসাম্প্রদায়িক এক বাঙালি সত্তার শুরু, সে কথা বারবার লিখেছেন।’
স্যার আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু নিজেই এটা লিখিনি। বঙ্কিমচন্দ্রও এটা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—চন্ডীদাস, রঘুনাথ শিরোমণি, রঘুনন্দন, চৈতন্যদেব, বৈষ্ণবসাহিত্য, সবারই আবির্ভাব পনের শ আর ষোল শ সালে। বঙ্কিম বলেছিলেন, সুলতানী আমলের দু শ বছরে বাঙালির মানসিক জ্যোতিতে তার মুখ যেরকম উজ্জ্বল হয়েছিল, সেরকম এর আগে বা পরে কখনোই আর হয়নি।‘
আমার ভাল লাগল বঙ্কিমের এই মূল্যায়ন (রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্কিম—এই তিন ছিলেন স্যারের সবচেয়ে জ্ঞানগর্ভ ও প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মূল্যায়নের জায়গা), আর ওই আমরা চলে এলাম প্রথমে যদুনাথ সরকার এবং তার পথ ধরে জয়া চ্যাটার্জিতে। স্যার স্পষ্ট বললেন যে, পলাশীর যুদ্ধের শেষে ইংরেজরা যে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ শুরু করল, তার ফলে নতুন জন্ম নেওয়া হিন্দু জমিদার ও ইংরেজি পড়া শহুরে ভদ্রলোকেরা শুরু করে দিল হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের। তিনি বলতে লাগলেন কীভাবে যদুনাথ সরকার পলাশীর ১৭৫৭-র ২৩ জুনকে নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে বলেছেন যে, ওইদিন ভারতের মধ্যযুগের শেষ হল, ওইদিন শুরু হল ভারতের আধুনিক যুগের, ভারতের সত্যিকারের রেনেসাঁর, যা কিনা কনস্তান্তিনোপলের পতনের পরে যে বিপ্লবী ইউরোপ, তার চাইতেও বড় তাৎপর্যে ভরা এক বিপ্লবী রেনেসাঁ ছিল।
আমি তাঁর কথা শুনলাম। তাঁর সঙ্গে সম্মতি দিলাম আমাদের এই মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষের সঙ্গে বৃটিশ শাসনের যোগসূত্র বিষয়ে। এবং তাঁকে সুমিত সরকারের ‘Swadeshi Movement in Bengal’ বই থেকে বললাম যে, কীভাবে লর্ড কার্জন কোলকাতায় বসে অখণ্ড-অবিভাজিত বাঙালিদের শক্তির কথা বলতেন, সেই শক্তি বৃটিশদের জন্য কত বিপদের সেটা বলতেন, আর সেই একই লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে কীভাবে বলতেন যে, আপনারা দুই বঙ্গে ভাগ হয়ে যান, ভাগ হলে এখানকার মোহামেডানেরা সেই আগের মুসলিম রাজাদের আমলের সোনালী দিনগুলো ফিরে পাবে।
স্যার বললেন, ইংরেজ আমলে তাদের শাসননীতির কৌশল হিসেবেই যে তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এখানকার বাতাসে প্রথম ঢেলে দেয়, সে কথা তিনি তাঁর কমপক্ষে তিন-চারটা প্রবন্ধে লিখেছেন। আর বললেন সুমিত সরকারেরটা ‘সত্যি গ্রাউন্ডব্রেকিং কাজ।’ আমি বললাম, ‘জয়া চ্যাটার্জির “Bengal Divided” বইটাও তাই।’
স্যার আমার কথায় পুরো সায় দিলেন না। তিনি বললেন, ‘জয়া খুব ভালভাবে বুঝেছেন যে, যদুনাথ সরকারেরা কীভাবে ব্রিটিশ শাসন এলে খুশিতে বাগবাগ করেছিলেন। কীভাবে তারা ভেবেছিলেন যে, মধ্য এশিয়া থেকে আসা বর্বর ও খুনেদের স্বৈরশাসনের শেষ হল। কিন্তু তুমি ওই জয়ারই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় “হিন্দু ঐক্য ও মুসলমান স্বেচ্ছাচার” পড়ো, তাহলে বুঝবে হিন্দু সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতে গিয়ে কী করে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা এগিয়ে নিতে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আকৃষ্ট করে টেনে আনার ক্যাম্পেইনগুলোকে ওদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার বিপরীতে দেখানো হয়। ওই দ্যাখানোর পুরো ভাবটা দেখ।‘
আমি স্যারের কথা কিছুটা বুঝলাম, কিছুটা বুঝলাম না। তবে তাঁর কথার হালকা প্রতিবাদ করে বললাম যে, ‘স্যার, ওই অধ্যায়ের কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমি আপনার বাসায় আসব, আপনি আমাকে বই খুলে দেখাবেন যে জয়ার লেখার কোন্ কোন্ জায়গা পড়ে আপনার এমনটা মনে হল?‘ আরও বললাম, ‘ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই যে ইতিহাসে সবসময়েই নেতিবাচক কিছু ছিল সেটা বলার দিন শেষ। এখন ক্ষমতাকে অন্যভাবে দেখা হচ্ছে, স্যার। কিম্বা বলা হচ্ছে যে অন্যভাবে দেখা যায়। আমি বলছি যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ যেহেতু হয়েই গেছে, সেটা নিয়ে আক্ষেপেরও তাই দিন শেষ। আমার ধারণা আপনি জয়ার কথা ধরে আসলে মনগড়া (ঠিক এতটা কঠিন এক শব্দ বলেছিলাম কিনা মনে নেই, কিন্তু এরকমই কিছু ছিল সেটা) আক্ষেপ করছেন দেশভাগ নিয়ে।‘
স্যার আমার কথা মানতে পারলেন না। বেশ জোরের সঙ্গেই তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার আক্ষেপটা ব্যক্তিগত না, মাসরুর। এটা ঐতিহাসিক। কী হলে কী হতে পারতো, তার অ্যাজাম্পশন।‘
আমি স্যারের কথা বুঝলাম। ইতিহাস নিয়ে যারা বেশি মেতে থাকেন, তাদের মধ্যে এইগুলো হয়, এই যে সময় ও পরিস্থিতি নিয়ে সম্ভাবনার গেম খেলার ব্যাপারটা। তারপর তারা ডিপ্রেশনে চলে যান, কারণ ‘সময়’ (আর্কিওলজিক্যাল বিচারে ‘ক্ষমতা‘) কিছুই আর বাস্তবে ফের একবার পরীক্ষিত হতে দেয় না। আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, বর্ধমান, ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুরে মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠেরা গরু কুরবানি দেওয়া শুরু করলে এই সমাজে তাদের ক্ষমতা বেড়েছিল, মর্যাদা বেড়েছিল। তাই তখন প্রতীকী অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা হেরেছিল। কিন্তু ওটারই প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুরা ফজলুল হক ও নাজিমুদ্দিনের আমলে কলকাতার "মুসলিম" সরকার থেকে ততই রেহাই পাওয়ার চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছিল। আর তাই জয়া চ্যাটার্জিই বলছেন যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের চিৎকার যে এই তিন জেলা থেকেই বেশি উঠেছিল, তাতে সন্দেহ কী? মুসলিমরা যদি "মুসলিম আবাসভূমি"-র কথা ভাবে, তাহলে হিন্দুরাও ক্ষমতার উল্টো ক্ষমতা দেখাতে "হিন্দু আবাসভূমি"-র কথা ভাববে।‘
আমাদের সেদিনের তর্ক-বিতর্কের নানা কিছু দেশের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এখানে আর বিশদ করা যাবে না। আমি শুধু এটুকুই বলব যে, সেদিন থেকে শুরু করে করোনায় অসুস্থ হওয়ার দিন অবধি আমাদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন চলতে থাকা (কোনো কোনো দিন একবারের অধিক) কথা বা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলেন এক আসল শামসুজ্জামান খান—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো উদার চিন্তার, আবার একই সঙ্গে রক্ষণশীল; সমাজতাত্ত্বিক চিন্তায় মূলত আপসবাদী; মানবিক ঔচিত্যবোধে প্রবল বিশ্বাসী; বাঙালির সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আর রাজনৈতিক সত্তার অখণ্ড অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে প্রবল গুরুত্ব দানকারী; আর সবকিছুর ওপরে ফরাসি বিপ্লবের তিন মটোকে জীবনের অভিষ্ট মানার পাশাপাশি একইসঙ্গে জীবনদেবতার রূপ-অপরূপের অজ্ঞাত রহস্যে মোড়া রাবীন্দ্রিক অধ্যাত্মজগতে বিশ্বাসী এক ষোলআনা সেকুলার মানুষ।
তাঁর পরমাত্মার-সন্ধানী আধ্যাত্মিকতা ও ভাববাদের সঙ্গে আমাদের মতো পোস্টমডার্ন জেনারেশনের মানুষদের চিন্তার পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বুঝেছি যে, মানবিক মূল্যবোধের সপক্ষে দাঁড়ানো, দেশপ্রেমের আসল জায়গাটাতে বিশ্বাস রাখা এবং শ্রেণী-ধর্ম-জাত-পাত পেরিয়ে মানবিক সংবেদনশীলতার যে নরম কোনাটায় আস্থা রাখার নতুন নাম ‘প্রগতিবাদ‘ (অন্তত এদিককার ‘প্রগতিবাদ‘), শামসুজ্জামান খান ও আমি, দুজনেই ইতিহাসের এই টগবগিয়ে ফুটতে থাকা গরম কড়াইটার দিকে তাকিয়ে থেকে, চারপাশে একগাদা ‘ছদ্ম‘ প্রগতিবাদী পরিবেষ্টিত হয়ে, আহত মনে আজ সেই একই ‘বাদ‘-এর সেনানী। আর সে কারণেই বুঝি আমি তাঁর এতটা কাছাকাছি চলে এসেছিলাম সামান্য দেড় বছরের মধ্যেই।
আমি বুঝতাম স্যারের অপছন্দের ছিল আমার চিন্তার মার্ক্সিস্ট বাঁকটুকু, যেহেতু রবীন্দ্র গুপ্ত কিংবা মুনীর চৌধুরীদের মতো মার্ক্সবাদীরা তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়নে, তাঁর হিসেবে, বিরাট ভুল করে গেছেন। আবার তাঁর মনে এই বিশ্বাস প্রবল ছিল যে, ভবানী সেন বা ছদ্মনামে ওই রবীন্দ্র গুপ্ত কি বীরেন পালদের রবীন্দ্র মূল্যায়ন তবু হাজার গুণ ভাল সৈয়দ আলী আহসানদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার নামে বাংলা ও বাঙ্গালিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবার চাইতে। আর আমি যেহেতু আর যা-ই হই মুসলমান বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনার সঙ্গে পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় দর্শন ও আদর্শের কোনো ফারাক আজও করতে পারি না (ঐতিহাসিক কারণেই), তাই শেষমেশ স্যার ঠিকই বুঝতেন যে, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার ভেদরেখার কোন্ জায়গাটাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এবং তাই তিনি বারবার বুকে টেনে নিতেন আমাকে, যদিও তিনি এটাও স্পষ্ট বুঝতেন যে, আমি তাঁর বা তাদের সময়ের মডার্নিস্ট মানুষদের মতো কোনো খাড়াদণ্ড-সোজাস্তম্ভ ভলতেয়ারিয়ান ‘মানবতাবাদী’ নই।
আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা এটাই মনে পড়ে যে, আমি স্যারকে বলছি, ‘স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পে-প্রবন্ধে-কবিতায়-নাটকে-গানে কতভাবে দেখিয়েছেন যে তিনি শোষণ-পীড়ন, অভক্তি-অশ্রদ্ধা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, বিভেদ-বিরোধের বিরুদ্ধপক্ষের লোক। তিনি ন্যায়যুদ্ধের পক্ষের লোক। এগুলো তো আপনারই বলা কথা। তো, কেউ কি দেখে না সেটা?’
সেদিন স্যার নিকট অতীতে তাঁর একদিন মানিকগঞ্জ থেকে ফেরার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ওখানকার এক স্থানীয় স্কুল শিক্ষক তাঁর কাছে ইনিয়েবিনিয়ে কথা পেড়েছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের চরণগুলো নিয়ে। এমন যে, এই বাংলার অধিকাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওই গানের কথাগুলো যায় না। এমন যে, সত্যি বলতে আমাদের জাতীয় পতাকার লাল-গোল টিপও ইসলামী চেতনার সঙ্গে যায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই স্যারের কণ্ঠে সেদিন ছিল বিরাট বিষাদ। সে কারণেই তিনি সেদিন আমার কথা শুনে রীতিমতো ঝলমল করে উঠে আমাকে বললেন, ‘মাসরুর, কোনোদিন কোনো মানবতাবাদীর বিচার সেই মানুষটা সামন্তবাদী নাকি পুঁজিবাদী নাকি সাম্রাজ্যবাদী নাকি অধ্যাত্মবাদী ছিলেন বা আছেন, সেইটা দিয়ে করতে যাবে না। তাহলে তাঁর প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। নিজের মতটাই ঠিক মত, নিজের পথটাই ঠিক পথ—ওই ধরনের বিচারে এই বিবেচনা বা বিচারগুলোই ফুটে ওঠে।’—ওদিনই ছিল স্যারের বাসায় আমার শেষবারের মতো যাওয়া। আমি তাঁর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে, আর কীভাবে চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল দ্রুত, আমাদের তরফ থেকে এক ভ্রুক্ষেপহীন মনোভঙ্গি দেখে সম্ভবত।
এবার আসি আমার বিচারে তাঁর শক্তির সবচাইতে প্রবল দিকগুলো নিয়ে। তিনি আমার কাছে সবচেয়ে শ্রদ্ধার্হ্য তাঁর বাংলার রাজনীতিতে গ্রামের অভ্যুদয় নিয়ে এক নিজস্ব ধরনের অভিজ্ঞানের জন্য। তা ছাড়া মফস্বলের সংস্কৃতি, স্বামী বিবেকানন্দ, ভদ্রলোকের চোখে এই দেশ, ছোটলোকের চোখে এই বাঙালি হওয়ার স্বরূপ, কেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়, কেন এই পারস্পরিক ধর্মভিত্তিক ঘৃণা, লর্ড কার্জন তাঁর বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে কী দাঁড়াত ভারতীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেহারাটা, আর রামমোহন, কেশবচন্দ্র ও রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক সমন্বয়বাদ বোঝার সঙ্গে মুসলিম রাজনৈতিক চেতনাকে বোঝার ব্যাপারটা কীভাবে জড়িত, কীভাবে শরৎচন্দ্র ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষের লোক ছিলেন আর তা ঠিক কী প্রভাব ফেলেছিল হিন্দু মধ্যবিত্ত মানসিকতায়, এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস ও বাঙালির বাঙালিত্বের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের পুনর্মূল্যায়নটা আমরা কীভাবে করব, ঠিক তাঁর কোন্ কোন্ লেখা ধরে কাজটা শুরু করব—প্রথমত এসব প্রশ্নকে জানবার এবং তার প্রতিটারই সবচাইতে স্বচ্ছ উত্তর হাজির করবার বিষয়ে আমার কাছে প্রায় শেষ-কথা ছিলেন শামসুজ্জামান খান।
কিন্তু তার চাইতেও বড় আমার কাছে তিনি ছিলেন এই বোঝাবুঝিটুকুর জন্যে যে (স্যারকেই স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করে বলছি): ‘মাসরুর, দ্যাখো এই মাটিতে বৈদিক ধর্ম ছিল, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছিল, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ধর্ম ছিল, ছিল জৈন ও বৌদ্ধ; কিন্তু হিন্দু ধর্ম বলে আলাদা কোনো ধর্ম ছিল না। আর এবার ভূগোলের দিকে তাকাও— বাংলায় বাঙালি ছিল, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, উড়িষ্যায় ওড়িয়া, তামিলনাড়ে তামিল, কিন্তু ভারতীয় জাতি নামে আলাদা কোনো জাতিসত্তা ছিল না। তাহলে কীভাবে হঠাৎ কোত্থেকে জন্ম নিল হিন্দুধর্ম, আর ভারতীয় জাতি নির্মাণের বাসনা? মনে রাখবা, ভিনদেশের কেউ ভারত দখলের আগে ভিনদেশের ধর্ম ভারত দখল করেছিল। ইসলাম নামের একদম সুসংগঠিত এক ধর্ম এখানে যেই এলো, তারই প্রতিক্রিয়ায় এলো নিজেদের মাটির হিন্দু ধর্ম খাড়া করবার বোধ, আর এলো হিন্দুত্বের বেসিসে এক অখণ্ড হিন্দু ভারতীয় জাতির ভাবনা। এই মাটিতে ইসলামের সবচাইতে বড় অবদান এইটা যে, সে হিন্দুধর্মের থিওলজিক্যাল চেহারাটার অতিরিক্ত সামাজিক সাংস্কৃতিক রূপরেখাটারও জন্ম দিয়েছে। একটা কাজের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটার জন্ম হওয়া ইতিহাসে স্বাভাবিক কথা। তেমনই স্বাভাবিক যে, গ্রামবাংলায় এখন এই যে বাঙালিত্বকে হিন্দুয়ানী বলা, বেসিক্যালি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা সম্পন্ন এক ইসলামী চেতনার নতুন বিরাট জোয়ার চলছে, এর প্রতিক্রিয়ায় একদিন এই রাষ্ট্র তার আধুনিকতামনষ্ক স্বতন্ত্র এক সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলিমের জাতিরাষ্ট্রচিন্তার আসল যে ব্যতিক্রমী পরিচয় “সেক্যুলারিজম”, সেটা হারাবে।‘
আমি স্যারকে বলেছিলাম, ‘স্যার, ভয় লাগে। আর বলবেন না। আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন মতো হয়ে যায়।’
স্যার বলেছিলেন, ‘আমারও ভয় লাগে।…আলথুসার-এ তুমি পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীর সংগ্রামগুলোকে কী সুন্দর করে লিখেছ। এবার আমাদের এই ভয়টা নিয়ে লেখো। শুরু করতে পারো সুনীতিকুমারের বই "ইরানিয়ানিজম" থেকে। আছে তোমার কাছে? না থাকলে ড্রাইভার পাঠাও। আমারটা নাও।’
আমি পরশু বা পারশ্ব নামের বৈদিক আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় আর্যদের মিথস্ক্রিয়ার কথা ভাবছি; স্যারের কাছ থেকে ক্লু নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি যে, কীভাবে সেই মিথস্ক্রিয়া থেকে জন্ম হল আমাদের প্রিয় শব্দ ‘রিলিজিয়ন‘-এর—মানে ধর্ম, মানে নামাজ ও পূজাপাঠের অতিরিক্ত আমাদের স্বপ্ন সে, আমাদের আত্মা, আমাদের ভাত সে, আমাদের মাছ, আমাদের কলারের কাপড় সে, আর কলারের নিচে থাকা গলার কাছের এক জোট-ঘোঁট-দলা।
গলার কাছে স্পষ্ট এক দলা নিয়ে আমি শামসুজ্জামান খান স্যারের দামি ও দরকারি কথাগুলো মনে করছি আজ।
( মাসরুর আরেফিন. সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এমডি)