করোনার ঝুঁকিতে ২৯ জেলা!
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ব্যাপক হারে বাড়ছে সারা দেশেই। এর মধ্যে ২৯টি জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ১৩ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত দেশে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা জেলার সংখ্যা প্রায় ছয় গুণ হয়েছে। গত ১৩ মার্চ যেখানে এমন ঝুঁকিপূর্ণ জেলার সংখ্যা ছিল ৬, সেখানে ২৪ মার্চ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ জেলায়।
অর্থাৎ, এই ১১ দিনের ব্যবধানে দেশে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জেলার সংখ্যা বেড়েছে ২৩টি। ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকায় আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, গাজীপুর, শরীয়তপুর, নীলফামারী, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, খুলনা, নরসিংদী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মাদারীপুর, নওগাঁ, রাজশাহী প্রভৃতি।
দেশে টানা দুই দিন ৫ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। প্রতিরোধই উত্তম ব্যবস্থা হলেও কেউই মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। এমন অবস্থার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি পালনে আজ বুধবার থেকে সারা দেশে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ জানান, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানতে এত দিন আমরা জনগণকে সচেতন করেছি। তবে এখন যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে আজ থেকে আমরা কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছি।’
এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ যে গতিতে ছড়াচ্ছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম সেই গতিতে এগোচ্ছে না। প্রতিরোধই উত্তম ব্যবস্থা হলেও কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারলে দেশ কঠিন অবস্থায় পড়বে। তবে এটা রোধ করা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে যা যা করার তা-ই করতে হবে। কারোর খামখেয়ালির জন্য অন্য মানুষের ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। করছি, হচ্ছে—এগুলো আর শুনতে চাই না। বাস্তবায়ন করে ফেলেছি—এটা শুনতে চাই। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সেবাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দ্বারা পরিচালনা, উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। আর বিদেশ থেকে আসা সবার ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেখানে-সেখানে লাশ পড়ে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
আইসিডিডিআর’বির ভাইরোলজি ল্যাবরেটরির প্রধান জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে করোনার ইউকে, সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট কিছু পাওয়া গেছে। তবে বেশির ভাগই লন্ডন ভ্যারিয়েন্ট। এটা দ্রুত ছড়াচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ উপসর্গ নিয়ে ঢাকায় এসে পরীক্ষা করে পজিটিভ রিপোর্ট পাচ্ছে। তিনি বলেন, গত বছর এই সময়ে করোনা ঊর্ধ্বমুখী ছিল, এবারও ঊর্ধ্বমুখী। নিয়ন্ত্রণ করতে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা দ্রুত নিতে হবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ড. সমীর সাহা বলেন, করোনার ইউকে ভ্যারিয়েন্ট সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। আর এদেশের মানুষ সব দেশে আছে। তাই লন্ডনফেরতদের নয়, বিদেশ থেকে যারা দেশে আসবে, তাদের সবারই ১৪ দিন বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তিনি বলেন, অনেকে নাকের নিচে মাস্ক পরেন। এই ফ্যাশন বন্ধ করতে হবে। সঠিক নিয়মে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানুষকে মানাতে যা যা দরকার তাই করতে হবে। গাড়ির ভেতরে ড্রাইভারসহ যাত্রীরা, দোকানে, হোটেলে সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক না পরলে কেউ কোনো ধরনের সার্ভিস পাবে না—এমন সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে করোনার ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য মোবাইল কোর্টের হাজির হতে হবে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরে করোনার চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামের মানুষের চিকিৎসা সেখানে নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামে কেউ মাস্ক পরে না। তাদের ভাব এমন যে, গ্রামে করোনা নেই। গ্রামের মানুষ জটিলতা নিয়ে যখন ঢাকায় আসে, পরে তাদের অর্ধেকেরও বেশি পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়ে। ঢাকায় করোনার যেসব রোগী চিকিত্সাসেবা নিচ্ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি রোগী ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। ঢাকার বাইরের রোগীদের নিজ নিজ জেলায় সেবা দেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাটবাজার, বইমেলাসহ সব জায়গায় মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, আমরা শুধু বলতে পারি, হইচই করতে পারি। যদি কেউ মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি না মানে, তাহলে আমাদের কী করার আছে? স্বাস্থ্যবিধি পালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নইলে করোনা ভাইরাস যে গতিতে ছড়াচ্ছে তা রোধ করা সম্ভব নয়।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫ হাজার ৪২ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; মৃত্যু হয়েছে আরো ৪৫ জনের। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৬ লাখ ৫ হাজার ৯৩৭ জনে। আর গত এক দিনে মারা যাওয়া ৪৫ জনকে নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট ৮ হাজার ৯৯৪ জনের মৃত্যু হলো। এর আগের দিন সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫ হাজার ১৮১ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে; মৃত্যু হয় ৪৫ জনের।