রাজনীতিমুক্ত না হলে ব্যাংকের সংস্কারে সুফল হবে না

রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপ থেকে মুক্ত না হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃঢ়তা দরকার। রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, ব্যাংকের মতো একটি প্রযুক্তিনির্ভর খাতকে সবসময় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা উচিত।
গতকাল শনিবার দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও সুশাসন শীর্ষক গোলটেবিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ওয়ান ব্যাংকের সহায়তায় অলাভজনক পরামর্শক ও গবেষণা সংস্থা দি ঢাকা ফোরাম (টিডিএফ) আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট ফারুক সোবহান, বাংলাদেশে নিযুক্ত জর্ডানের রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ, টিডিএফ অশোক দাস গুপ্ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পদস্থ ও সাবেক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন টিডিএফ সদস্য সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।
দলীয় বিবেচনায় ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া’ সমর্থন করে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, কিন্তু তাকে বলে দিতে হবে, খবরদার তুমি তোমার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে কথা-বার্তা বলবে না। ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তন যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হয়, তাহলে সেখান থেকে সুফল আসবে না। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্ব দিয়ে আসা এই অর্থনীতিবিদ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, গভর্নরকে শুধু যে রাজনৈতিক চাপে থাকতে হয় তাই নয়, লবিস্টরাও অনেক চাপে রাখেন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি শক্ত অবস্থান নিতে হবে। চাপমুক্ত হয়ে কাজ না করতে পারলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করা যাবে না। আলোচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক’ কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কি আসলে হচ্ছে? এসএমই খাতে কি টাকা যাচ্ছে? আমার এক বন্ধু সেদিন আমাকে বললো, ১০ লাখ টাকার জন্য সে ছয় মাস ধরে ঘুরছে। এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, এসএমইর টাকা যাচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে, গরিবরা পাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে দেশে উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকগুলোর ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকিংয়ের অবস্থা যথেষ্ট ভালো। তাতে অর্থনীতি কলাপ্স (ধ্বংস) করার মতো সুযো নেই। এ নিয়ে প্যানিক (ভয়) সৃষ্টি করাও ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ব্যাংকিংয়ে নিয়মতান্ত্রিকতা ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা দিতে হবে। মনিটিরিং ও ব্যবস্থাপনা দু‘টো বিভাগকে পৃথক করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বড় সমস্যা হলো, অনেকগুলো ব্যাংক। কিন্তু সে তুলনায় ব্যবসা ক্ষেত্র কম। দেশে রাজনৈতিক সরকার থাকতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে না, এটা কঠিন। তারপরও লোন দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহানুভূতি নয়, প্রতিযোগিতা ও প্রাপ্তিযোগ্যতা বিবেচনা করতে হবে।
বক্তারা ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আমাদের দেশের বড় সমস্যা, এখানে অনেক বেশি ব্যাংক। তাও আবার বেশিভাগই পরিবারতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক। মালিক রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু ব্যাংক পরিচালনায় সেটার প্রতিফলন থাকতে পারবে না। ব্যাংকিংয়ের জন্য পেশাদারিত্ব বড় ব্যাপার। ঋণ দেয়ার সময় রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে যোগ্যতার প্রতিযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বাংলাদেশের রাস্তা নিয়মতান্ত্রিক হলে অর্থনীতিও নিয়মতান্ত্রিক (স্থিতিশীল) হবে। রাস্তায় যে হারে যানজট-অনিয়ম, এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকবে না।