শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয় অধ্যাদেশে বাড়তে পারে সময়সীমা

শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠেছে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলে। এজন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারির সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা হয় সেখানে। ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করে শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইএমইডি সচিবসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও সম্প্রতি শেয়ারবাজারে টানা দরপতন চলছে, যা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মূলত আগামী ২১ জুলাইয়ের মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করেই এ দরপতন হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা আরো বাড়ানো উচিত বলে মত দেন তিনি।
বৈঠকে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে সম্ভব না হলে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করে আইনটি সংশোধন করা যায় কিনা, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও সিদ্ধান্ত হয়।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম. আসলাম আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারী এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ইউনিলিভার, নেসলেসহ বেশকিছু বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করলেও তারা শেয়ারবাজারে আসছে না। অথচ এসব কোম্পানি বিশ্বের অন্যান্য দেশে তালিকাভুক্ত। এসব কোম্পানি বাজারে এলে শেয়ারবাজারের আকর্ষণ যেমন বাড়ত, তেমনি আস্থার পরিবেশও সৃষ্টি হতো। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে নোট নেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
প্রসঙ্গত, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ২১ জুলাইয়ের মধ্যে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তাদের মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। পরে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ব্যাংক তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা নিজস্বভাবে আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংসের মোট পরিমাণের ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। একই সঙ্গে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।
এছাড়া ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে (ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি) ব্যাংকের ইকুইটি শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ গণনায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগও ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার কথা জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার জারির মাধ্যমে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত সব ধরনের সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগসীমায় গণনা করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের নির্দেশনার কারণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারের চাপে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে বিনিয়োগ প্রত্যাহার না করায় ১৫টিরও বেশি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। স্বল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির এ সম্ভাব্য চাপ বাজারে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব শেয়ারের নিট ক্রেতা নেই।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রত্যাহারকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরেই শেয়ারবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হওয়ায় সম্প্রতি শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। গত এক মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচকটি ৪০০-এর বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে। আর লেনদেন নেমে এসেছে ৩০০ কোটি টাকার নিচে। চলতি সপ্তাহের চার কার্যদিবসেই মূল্যসূচকের পতন হয়েছে। আরো দরপতনের আশঙ্কায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) এরই মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো।
ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারে সময় বাড়ানোর পাশাপাশি শেয়ারবাজারে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ মূল কোম্পানির বিনিয়োগ গণনায় হিসাব না করারও দাবি জানায় সাবসিডিয়ারিগুলো।