শিরোনাম

South east bank ad

ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ঋণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা

 প্রকাশ: ১৯ অগাস্ট ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ঋণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা

দিন যত যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের নানা অনিয়মের তথ্য বের হয়ে আসছে। দখলে নেয়ার পর ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে, বেনামে ঋণ নিয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার। এসব ঋণের অধিকাংশ অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

তথ্যে দেখা যায়, সেঞ্চুরি ফুড প্রডাক্ট, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স এবং মুরাদ এন্টারপ্রাইজ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের তিনটি শাখার গ্রাহক। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে গত জুলাই শেষে ব্যাংকের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। ঋণের কাগজপত্রে চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের যে ঠিকানা ব্যবহার করে এসব ঋণ নেয়া হয়েছে, সেখানে পাওয়া গেছে আবাসিক ভবন ও ঢেউটিনের দোকান।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণস্থিতি রয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। মোট আমানত রয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ৭৪ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের অর্ধেক। সরাসরি এস আলম গ্রুপের সাত প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

এস আলম বা সাইফুল আলমের জামাতা ও এসআইবিএলের চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদের নামে প্রতিষ্ঠিত ইউনিটেক্স গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ৪৫৫ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের নামে নেয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অঙ্কের সুবিধাভোগী এস আলম। এর বাইরে বেশির ভাগ ঋণ নেয়া হয়েছে অস্তিত্বহীন, সাইনবোর্ডসর্বস্ব বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। ঋণ আবেদনে দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর বা অন্যান্য ডকুমেন্টের বেশির ভাগই ভুয়া।

বিপুল অঙ্কের ঋণ বের করতে বড় একটি চক্র গড়ে তোলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার নানা উপায়ে তাকে সহায়তা করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নানা সুবিধা নিয়ে তার পক্ষে কাজ করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়, তার মূল বিষয় ছিল এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপসারণ। গভর্নর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়েন ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, বিএফআইইউপ্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ফান্ডেড এবং ১০ শতাংশ নন-ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। আর গ্রুপ বলতে কোনো ঋণগ্রহীতা বা তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানিকে বোঝানো হয়। গত জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল ১০ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। এর মানে ফান্ডেড এবং নন-ফান্ডেড মিলে একটি গ্রুপকে এই ব্যাংক দিতে পারবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। এ নিয়মের চরম লঙ্ঘন হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে নিজেদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে এ রকম ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকটি থেকে বের করা হয়েছে ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এ ঋণের সবই নেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে এস আলম রিফাইন সুগার ইন্ডাস্ট্রির নামে ৩ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। সহযোগী প্রতিষ্ঠান চেমন ইস্পাতের নামে ৩ হাজার ৩৩৮ কোটি, এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের নামে ৩ হাজার ২৩২ কোটি, ইনফিনিট স্টিপ ইন্ডাস্ট্রির নামে ২ হাজার ২৮১ কোটি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের এক হাজার ৫৫১ কোটি, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের নামে ৯৭৫ কোটি টাকা এবং এস আলম স্টিলের নামে বের করে নেয়া হয়েছে ৭০ কোটি টাকা।

ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মোট ঋণ রয়েছে ১৭০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে কেবল এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া এস আলমের জামাতার প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলকে ২১৫ কোটি টাকা দিয়েছে ব্যাংকটির ওআর নিজাম রোড শাখা। আর ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের নামে একই শাখা দিয়েছে আরো ২৪০ কোটি টাকা।

ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন নামে ঋণ বের হলেও সরাসরি এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী এ রকম প্রতিষ্ঠানকে তারা গ্রুপটির বেনামি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ তালিকায় চট্টগ্রামের মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এ প্রতিষ্ঠানের নামে বের করা হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। মোট ১৭ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণসীমার বিপরীতে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ বের করা হয়েছে। মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের কর্ণধার আশরাফ হোসেন মাসুদ বলেন, তার নামে ইসলামী ব্যাংকে কোনো ঋণ নেই। একই রকম প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে অন্য কেউ ঋণ নেয়ারও সুযোগ থাকার কথা নয়। বিষয়টি জানার পর তিনি ইসলামী ব্যাংক থেকে একটি স্টেটমেন্ট নিয়েছেন।

বেনামি প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা ফিড মিলের নামে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম। এছাড়া মেডিগ্রীন ইন্টারন্যাশনালের নামে ১ হাজার ১৬২ কোটি, মার্টস বিজনেসের ১ হাজার ১৫৮ কোটি, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ১ হাজার ১৪৪ কোটি, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের ১ হাজার ১১৪ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেসের ১ হাজার ১২৩ কোটি, মুরাদ এন্টারপ্রাইজের ১ হাজার ৯২ কোটি, মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজারের ১ হাজার ৯১ কোটি, স্টেইট লাইন ইন্টারন্যাশনালের ১ হাজার ৬০ কোটি, সিলভার ফুডের ১ হাজার ৪৩ কোটি, আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলসের ১ হাজার ৪২ কোটি, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের ৯১৮ কোটি, নাবিল নাবা ফুডের ৭২৫ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ৬৭২ কোটি, টপ টেন ট্রেডিং হাউজের ৪৮৪ কোটি, নাবা ফার্মের ৫৪৫ কোটি, দেশবন্ধু সুগার মিলের ৪২০ কোটি, সুলতান এসোসিয়েটসের ৩৮১ কোটি, সোনালী ট্রেডার্সের ৩৪৭ কোটি, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলের ৩৯ কোটি এবং নাবিল অটো রাইস মিলের নামে বের করা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষ থেকে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বরাবর একটি চিঠি দিয়ে দ্রুত পর্ষদ পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ব্যাংকটিতে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপ ৮২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে। ব্যাংকটিতে একক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়েছে। ঋণের বেশির ভাগই পাচার করা হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলে এস আলম গ্রুপের তেল, চিনি, ছোলাসহ ভোগ্যপণ্যের ডিলার হিসেবে কাজ করে নাবিল গ্রুপ। গ্রুপটির নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ বের করে নিয়েছে এস আলম। ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালের মার্চে নাবিল গ্রুপের ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার সবই ছিল রাজশাহী শাখায়। গত জুলাই শেষে এই গ্রুপের বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ বের করতে নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে গিয়ে যোগ হয়। পরে নাবিল গ্রুপের ঢাকার বানানী ও রাজশাহীর সাইনবোর্ডসর্বস্ব ঠিকানা ব্যবহার করে দ্রুত ঋণ বাড়তে থাকে।

ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয়ার পরই শুরু হয় নামে-বেনামে টাকা বের করার আয়োজন। এজন্য আগে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের মধ্যে নিজস্ব একটি অনুগত বাহিনী গড়ে তোলে এস আলম। প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় শাখায় নিজের অনুগতদের বসানো হয়।

এস আলম গ্রুপের আস্থাভাজন ও সহায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী, ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বির ও কাজী রেজাউল করিম, দুই এসইভিপি মাকসুদুর রহমান, আহমেদ জোবায়েরুল হক ও এসইভিপি নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা। এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন গোপন খবর জানতেন এসব কর্মকর্তা। সরকার পরিবর্তনের পর এসব কর্মকর্তাকে আর ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

এস আলম দখলে নেয়ার পর গত সাত বছরে ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন পক্ষের তদবিরে কিংবা সাইফুল আলম মাসুদের নিজ এলাকা পটিয়ার বাসিন্দা। এসব কর্মকর্তাকে আর ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকে ৩৩২টি শাখার বিপরীতে কর্মী ছিল ১৩ হাজার ৭৬০ জন। শাখাপ্রতি লোকবল ছিল ৩৭ জন। ২০২৩ সাল শেষে ৩৯৪টি শাখার বিপরীতে লোকবল দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮০৯ জনে। শাখাপ্রতি লোকবল বেড়ে হয়েছে ৪৭ জন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো একটি ব্যাংকে একক ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠী সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিতে পারে। ইসলামী ব্যাংক দখলের পর নামে-বেনামে ২৪ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৩১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার ১৬৫টি শেয়ারের মালিকানা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৮১ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমের মালিকানাধীন জেএমসি বিল্ডার্সের নামে শেয়ার রয়েছে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার ৮১২টি, যা ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ ছাড়া বিটিএ ফাইন্যান্স, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল, এবিসি ভেঞ্চারস, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্লাটিনাম এনডেভার্স, এক্সেলশিয়ার ইমপেক্স, গ্র্যান্ড বিজনেস, লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস, বিএলইউ ইন্টারন্যাশনাল, আর্মদা স্পিনিং মিলস, কিংসওয়ে এনডেভার্স, ইউনিগ্লোব বিজনেস, সোলিভ ইন্স্যুরেন্স, হলিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল, হাই ক্লাস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, ক্যারেলিনা বিজনেস, ব্রিলিয়ান্ট বিজনেস, ব্রডওয়ে ইম্পেক্স, পিকস বিজনেস, এভারগ্রিন শিপিং, ম্যারাথন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, কিংস্টোন ফ্লাওয়ার মিলস ও পারসেপ্টা এনডেভার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ২ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রয়েছে।

BBS cable ad

ব্যাংক এর আরও খবর: