সরকারের দায় শোধে ডলার বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো

গ্রাহকের দায় পরিশোধে কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এর পরেও গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর গ্রাহক সামলাতে যখন হিমশিম খেতে হচ্ছে, তখন কিছু ব্যাংককে সরকারি কেনাকাটার দায় পরিশোধে সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে এ অর্থ পরিশোধ করত। মূলত আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত পরিপালনে জন্য একটি নির্ধারিত সীমার মধ্যে রিজার্ভ ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ পন্থা অবলম্বন করেছে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ চাপ আরো বেড়ে গেছে।
এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরেও রিজার্ভ প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুনের তুলনায় জুলাই শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বিপিএম-৬ অনুযায়ী দেশে জুলাই শেষে রিজার্ভ নেমেছে ২০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার, জুনে যা ছিল ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও, আইএমএফের হিসেব অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ আরো কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, পণ্য আমদানিতে বকেয়া দায় এখন ৭০০ মিলিয়নের ওপরে চলে গেছে। অনেক ব্যাংক নানা উপায় অর্থাৎ নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু সোনালী ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে এক ডলারও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে না। এর ফলে আগে যখন রেমিট্যান্স সংগ্রহের দিক থেকে সোনালী ব্যাংক শীর্ষ ৫ ব্যাংকের মধ্যে থাকত এখন ২০ ব্যাংকের মধ্যেও নেই। অথচ সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারের প্রায় যাবতীয় কেনাকাটার জন্য আমদানি ঋণপত্র স্থাপন (এলসি খুলে থাকে) করে থাকে। এর ফলে নিয়মিত আমদানি দায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
এ দিকে আগে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে প্রতিদিনই প্রয়োজনের একটি অংশ ডলার সরবরাহ করত। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আগের মতো আর সহযোগিতা করছে না। রিজার্ভ ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিকল্প উপায়ে অর্থাৎ অন্য ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে কিছু সহযোগিতা করছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংকসহ আরো ৪-৫টি ব্যাংক থেকে সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয়। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশে ব্যাংকগুলো সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে। এসব ব্যাংক থেকে যেটুকু ডলার পাওয়া যায়, তা দিয়ে সোনালী ব্যাংকের যৎসামান্য প্রয়োজন মেটানো যায়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে যতটুকু পাওয়া ও নিজেদের দৈনন্দিক আহরণকৃত রেমিট্যান্স দিয়ে দৈনন্দিন চাহিদার সামান্য চাহিদা পূরণ করা যায়। অর্থাৎ বিএডিসের এলসির দায় যেখানে ৫০ মিলিয়ন পরিশোধ করতে হবে, সেখানে পরিশোধ করা হয় ৫ মিলিয়ন। এভাবেই ব্যাংকটি তার বৈদেশিক বাণিজ্যের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করছে।
এ বিষয়ে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। তাদের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যতটুকু বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা যায়, চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি। এমনিতেই তাদের গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না, এরপর সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের নিজস্ব গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় অনেক গ্রাহক অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। অপর দিকে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নানা বাড়তি সার্ভিস দিয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে ব্যয়ে রেমিট্যান্স আহরণ করতে হচ্ছে। এতে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে তা সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বাড়তি দাম দিয়ে ডলার কিনে সোনালী ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত দরে অর্থাৎ ১১৮ টাকা দরেই রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে দিন শেষে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কিন্তু এ লোকসানের দায়ভার কেউ নিচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই বহন করতে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নানা কারণে আবার রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে রফতানি আয়। ইন্টারনেট ৭ দিন বন্ধ রাখার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব আরো বেশি পড়েছে। সামনে পরিস্থিতি উন্নতি না হলে ডলার সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে দাম। এতে আমদানি ব্যয় আরো যাবে, যা সঙ্কট আরো ঘণীভূত হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।