শিরোনাম

South east bank ad

নজিরবিহীন ভালোবাসায় সোহেল-রওশনের ১৫ বছর

 প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ, ত্রিশাল

একটি দশ টাকার নোটে লেখা ছিল নম্বর, অতঃপর কথা শুরু হয় ফোনে, এরপর ভাললাগা-আর ভালবাসার পথচলা। দীর্ঘদিনের প্রেম আর ভালবাসা রূপ নেয় পরিবারে। এখন সংসারও চলছে বেশ ভাল তবে ভাল একটি চাকুরী ছেড়ে স্ত্রীর সুবিদার্থে এখন একটি টং দোকানের ব্যবসায় চলছে কোন প্রকার।

বলছিলাম ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আমিরবাড়ী ইউনিয়নের খাঘাটি গ্রামের রওশন সোহেল দম্পত্যির কথা।

দম্পত্যির সাথে বলে জানাযায়, মনবিনিময়ের পরে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে রওশনের পরিবারের অমতে বিয়ে হয় তাদের। একসাথে থাকার অঙ্গীরকার নিয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে আর ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে রওশনের হাত ধরেন সোহেল। শুরু হয় এক সাথে পথচলা, যদিও তাদের এ চলা ছিলনা মোটেও সহজ। কেননা, অন্য আর দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ছিলনা ত্রিশালের রওশন আক্তার। তবে অন্ধ ভালোবাসায় এক অজানা সমস্যায় ভরা ভবিষ্যত হাসিমুখে বেছে নিয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোহেল মিয়া। ভালবাসাকে জয়ী করতেই সমাজের তোয়াক্কা না করে পরিবারের আপত্তি সত্বেও তারা আবব্ধ হন বিয়ের বন্ধনে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোহেল মিয়া আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ছোট বেলায় হারিয়েছেন বাবা-মাকে। ভাই-বোনের কাছে থেকে করেছেন পড়াশোনা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থানা বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে ভাল একটি চাকুরি নেন সোহেল মিয়া। একদিন বিকেলে অফিস ছুটির সময় তার টেবিলের ড্রয়ারে থাকা দশ টাকার একটি নোটে ফোন নম্বর লেখা দেখে ওই নাম্বারে একসময় কল করে। ওই কলের মাধ্যমেই রওশনের সাথে প্রথম পরিচয় সোহেলের। ধীরে ধীরে ফোনে কথা বলা সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে।

সোহেল মিয়া জানান, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আমাদের প্রেমের শুরুটা হলেও ডিসেম্বরে ভালবাসার টানেই প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক আপত্তিতেই বিয়ে করে ত্রিশাল উপজেলার বগারবাজার গ্রামের রওশন আরাকে। স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে নিজ বাড়িতে উঠতে চাইলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের আপত্তি কারনে যেতে পারেননি। চাকরী করলে স্ত্রীকে দেখাশোনার কেউ না থাকায় বেছে নেন একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা। এক পর্যায়ে সেই স্বচ্ছলতার জীবন ছেড়ে অভাবের সংসার মেনে নিয়েছেন অসহায় স্ত্রীর পাশে থাকতে। ভালোবাসা যেখানে অভাব অনটন দেখে দৌঁড়ে পালায়, সেখানে অভাবকে ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন এ দম্পতি। উপজেলার গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে ছোট্ট মাটির ঘর আর একটি টং দোকানই সম্বল এ দম্পতির। শত কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা আর পরস্পর আস্থা-বিশ্বাসই যেন তাদের কাছে সুখের সুপান।

জন্ম থেকেই দুই পা অচল রওশন আরার। পায়ে ভর দিয়ে নেই চলার শক্তিটুকুও। স্বামীর পিঠে চড়ে চলাচল শুরু করেন এখানে, ওখানে। হয়েছেন সন্তানের মা। কঠিন এ জীবন সংগ্রামে মসৃন পথ তৈরির মূলে ছিল প্রেম, ভালোবাসা, ভরসা ও বিশ্বাস।

তাদের ভালবাসা আর পারিবারিক বন্ধন নিয়ে সোহেল মিয়া আরো বলেন, শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম থাকলেও তার ভেতরে আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি আজ পর্যন্ত পাইনি। একজন স্বাভাবিক মেয়ে স্বামীর জন্য যতটুকু না করতে পারে সে তার চেয়েও বেশি কিছু করার চেষ্টা করে আমার জন্য। তার মূল গুণটাই হচ্ছে যে সে পুরোপুরি আমার ভক্ত। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না আর আমিও তার প্রতি পুরোপুরি আশ্বস্ত।
রওশন আক্তার বলেন, আমি যেহেতু প্রতিবন্ধী তাই আমার পরিবার থেকেও এ বিয়েতে সম্মতি ছিল না। তখন সবাই বলাবলি করেছে বিয়ের পর সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার একটাই আত্মবিশ্বাস ছিল আমি যে ছেলেটাকে ভালোবাসবো সেও আমাকে ভালোবাসবে। এই বিশ্বাসটাই আমি সোহেলের ওপর করতে পেরেছিলাম। সেজন্য সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার হাত ধরে আমি পালিয়ে যাই এবং বিয়ে করি। এরপর আমাদের মেয়ে সন্তান জন্ম গ্রহন করায় আমাদের ভালোবাসা যেন আরও বেড়ে গেছে।

রওশন আক্তার বলেন, কখনো কোথাও যেতে চাইলে আমি শুধু বলি আর সে তার পিঠে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করে। আমার মনের চাহিদা পূরণের জন্য সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। তাকে আমি ধন-সম্পদ কিছুই দিতে পারিনি, শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই দিয়েছি। আর সে আমার ভালোবাসা নিয়েই এখনো আমার সাথে আছে। আমরা সুখেই আছি।

সোহেল মিয়া বলেন, আমাদের সময়ের ভালোবাসাটাই ছিল অন্যরকম। অচল-অক্ষম মেয়েকে যেভাবে অন্ধের মত ভালোবেসেছি, তার মাঝেও তেমন ছিল অন্ধ প্রেম। এমন প্রেম এখন আর দেখা যায় না। এখনকার প্রেম হল প্রথমে দেখা, তারপর কথা, পরে অন্যকিছু। এই আছে এই নাই। কিন্তু আমাদের প্রেম ছিল পবিত্র প্রেম, সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে পাওয়া প্রেম।

সোহেল-রওশনের এমন নজিরবিহীন ভালোবাসার বন্ধন রীতিমতো অবাক করে স্বজন ও প্রতিবেশীদেরও। তারা বলেন, আমরা প্রথম অবস্থায় সোহেলকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ের পর কেউ কিছুদিন পর ছেড়ে চলে যাক তা আমরা চাইনি। তখন তাদের মতামতেই তারা বিয়েটা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রেমের এতটা আকর্ষণ তা বুঝতে পারিনি। সত্যিকারের প্রেম যে কতটা গভীর তা তাদের বন্ধ দেখেই আমরা বুঝতে পারি। রওশনকে পিঠে নিয়ে সোহেল যেভাবে আনা-নেওয়া করে তা দেখে আমরা সত্যিই অবাক হই।

ভালোবাসা মানে একজনের কাছে আরেকজনের দায়বদ্ধতা। সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকা। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়ার নামই ভালোবাসা। তবে স্বার্থের দুনিয়ায় যেখানে ঠুনকো আঘাতে সম্পর্ক ভাঙনের ছড়াছড়ি, সেখানে একজনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দুটি মানুষ কাটিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসাবাসীর প্রায় ১৫টি বছর।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: