বগুড়ায় আলু নিয়ে কৃষকের বোবা কান্না
প্রদীপ মোহন্ত, (বগুড়া):
বগুড়ায় আলুর দাম কমে যাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। হাটে-বাজারে আলুর আমদানি বেশি হওয়ায় এবং শীতের কারণে বাইরের ব্যাপারিরা না আসার কারণে আলুর দাম কমে গেছে।
গত কয়েকদিন ধরে বগুড়ার মহাস্থান পাইকারি বাজারে আলুর কেজি সাড়ে ৫ টাকা থেকে সাড়ে ছয় টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিমণ আলু বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা মণ দরে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও আলুর বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজিতে। আর এখন পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬টাকা কেজিতে। আলুর মোকাম হিসেবে পরিচিত বগুড়াতেই আলুর দাম এখন নিন্মমুখি। এতে করে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বোবা কান্না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাদা গ্র্যানুলা প্রতি মণ আলু বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা, অ্যাস্ট্রারিক বা স্টিক, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, ও ক্যারেট জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০ টাকা এবং লাল পাকড়ি জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা মণ দরে। যা খুবই কম।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, দেশের শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর একটি বগুড়া। কয়েক মৌসুম ধরে জেলাটিতে আলু আবাদ ও উৎপাদন ভাল হওয়ার কারণে আলুর দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল। গত মৌসুমে জেলায় আলুর ফলন হয়েছিল প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে বগুড়া জেলায় আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫৫ হাজার ৪৫৪ হেক্টর। আর ফলন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৮ হাজার মেট্রিক টন। শেষ পর্যন্ত বগুড়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ভাল ফলন পাওয়া যায় বগুড়ায়। গত কয়েক বছর ধরে বগুড়ায় ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় আলুর দাম নিয়ে কৃষকরা খুশি না হতে পারলেও বাজার ব্যবস্থায় আলুর দাম সহনীয় থাকায় ভোক্তারা ছিল নিশ্চিন্ত।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ভালো ফলনের কারণে জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার উৎপাদিত উন্নতমানের আলু জেলা ও দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। প্রায় এক যুগ ধরে এ জেলার আলু রফতানি হচ্ছে এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিআরব, বাহরাইন, সংযুক্তআরব আমিরাতে।
জেলার মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়। এ উপজেলায় বিভিন্নজাতের আলুর চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেসব আলু বেশি হয়ে থাকে সেগুলো হলো স্থানীয় জাতের আলু পাকড়ি ও হাগড়াই। এ ছাড়াও উচ্চ ফলনশীল আলু অ্যালভেরা, গ্র্যানোলা, অ্যাস্ট্রারিক বা স্টিক, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড। ডায়মন্ড, অ্যাস্ট্রারিক ও ক্যারেট জাতের আলুর বিদেশে চাহিদা বেশি বলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
বগুড়া সদর, শিবগঞ্জ উপজেলা, ঘোড়াধাপ, নামুজা, চাঁদমুহা এলাকার কয়েকজন আলু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর আলুর ভাল ফলন পাওয়া যায়। ভাল ফলন পাওয়া গেলেও বাজারে ভাল দাম ছিল না। কিন্তু এবার শুরুতেই আলুর ফলন ভাল। একারণে কৃষক আশায় বুক বেঁধে ছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে আলুর প্রচুর আমদানি হলেও শীত বাড়ার কারণে বাইরের পাইকাররা হাটে আসছেন না। আর এতে করেই আলুর দরপতন ঘটেছে।
কৃষক বলছে, এই দামে আলু বিক্রি করায় লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।
শিবগঞ্জ উপজেলা তেঘরি এলাকার আলু চাষি ছামসুল ইসলাম জানান, আলুর দাম কম। আলু বিক্রি করে খরচ উঠেছে না। গতকাল ১২ মণ গ্র্যানুলা আলু বিক্রি করেছে ২৫০ টাকা মণ দরে।
শিবগঞ্জ উপজেলার মিরেরচক গ্রামের বাসিন্দা মহাস্থান হাটের ব্যাপারী মজনু মিয়া জানান, প্রতিদিন মহাস্থান হাটে প্রচুর আলু আমদানি হচ্ছে। সেই হিসেবে পাইকার বা ব্যাপারিরা আসছেন না। এখানকার আলু বেশির ভাগ শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর এলাকায় যায়। কিন্তু বেশি শীতের কারণে ওইসব জেলার পাইকাররা আসছেন না। এজন্য দাম পড়ে গেছে। শীত কমলেই আলু দাম বাড়তে শুরু করবে।
মহাস্থার হাটের শাহ সুলতাল সবজি আড়তের স্বত্বাধিকারি বাবু মিয়া আলুর দাম কমা প্রসঙ্গে বলেন, এখনো বেশ কিছু হিমাগারে পুরোনো আলু মজুত আছে। যেগুলো ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার ওজন ৬৫ কেজি। কিছু ব্যাপারি লাভের আশায় সেসব আলু ধুয়ে বাইরে জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য নতুন আলু বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
বগুড়ার কৃষি অধিদপ্তর বলছে, জেলায় মোট ৩৭টি আলু সংরক্ষণের হিমাগার রয়েছে। তবে একটি বন্ধ থাকায় বর্তমানে জেলায় ৩৬টি হিমাগার চালু আছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ১০টি হিমাগার, শিবগঞ্জে ১২টি, কাহালু ও শেরপুরে চারটি করে, শাজাহানপুর ও দুপচাঁচিয়ায় দুইটি এবং নন্দীগ্রাম ও আদমদীঘিতে একটি করে হিমাগার রয়েছে।
জেলার হিমাগারগুলোতে প্রতি বছর ২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিকটন আলু সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারগুলো আলু কেনা শুরু করলে আলুর দাম আবার বেড়ে যাবে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ দুলাল হোসেন জানান, সবজি হিসেবে আলুর উৎপাদন বরাবরই ভাল। গত বছর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভাল ফলন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমদানি বেড়ে যাওয়ায় আলুর দাম সামান্য কমেছে। তাছাড়া শীতের কারণে বাইরের জেলায় পাইকাররা না আসায় দাম কিছুটা কমে গেছে। তবে শীতের প্রকোপ কমে গেলে বাইরের পাইকার আসতে শুরু করবেন। তাছাড়া বিদেশে যারা আলু রফতানি করেন তারাও কিনতে শুরু করবেন। সেই সঙ্গে সংরক্ষণের জন্য হিমাগারগুলো আলু কেনা শুরু করলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।