South east bank ad

গ্যাস হাইড্রেট কি জ্বালানি রক্ষাকবচ?

 প্রকাশ: ১১ জানুয়ারী ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

গত (৬ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে 'গ্যাস হাইড্রেট' নামক কঠিন পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই কঠিন পদার্থ থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া সম্ভব। এই সংবাদ সম্মেলনের সূত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার খবর মহা সমারোহে প্রচার করে। এতে জনগণ যে ধারণা পায়, তা দুর্ভাগ্যজনক ও বিভ্রান্তিকর।

২.
গ্যাস হাইড্রেট মিথেন ও পানি মিলিয়ে গঠিত একটি কঠিন পদার্থ। এমন পদার্থে সমৃদ্ধ অনেক দেশই। পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলিয়ে গঠিত একটি তরল পদার্থ। তা থেকে আহরিত হাইড্রোজেনকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তি সহজলভ্য হলে নিশ্চয়ই হাইড্রোজেন বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বাজারে আসবে। পরিবেশ সংরক্ষণে কার্বনমুক্ত জ্বালানি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এই জ্বালানি এখনও বিবেচনায় আসেনি। গ্যাস হাইড্রেটে সম্পৃক্ত মিথেনকে জ্বালানি নিরাপত্তায় গ্যাসের বিকল্প হিসেবে সুদূর ভবিষ্যতেও বিবেচনা করা সম্ভব হবে না। কারণ আগামী পৃথিবীর অর্থনীতি কার্বনমুক্ত জ্বালানিনির্ভর হবে। শুধু পরিবেশ সুরক্ষাই নয়; বাণিজ্যিক বিবেচনায়ও বাজার প্রতিযোগিতায় কোনো ফসিল ফুয়েল আগামীতে টিকে থাকতে পারবে না। তাই গ্যাস হাইড্রেটের মতো জ্বালানির উৎস উন্নয়নে বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণায় জ্বালানি সমস্যা সমাধানে কোনো আশার আলো আছে- এমনটি বলা যায় না।

৩.
সরকার ২০০৭-০৮ সালে বঙ্গোপসাগরে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিন হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার এবং ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রায় তিন হাজার লাইন কিলোমিটার সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপ সম্পন্ন করে। এ দুটি জরিপে ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে মহিসোপানে ছয় হাজার ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলে থাকা সম্পদ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। সেসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে 'ডেস্কটপ স্টাডি' করা হয়। এই ডেস্কটপ স্টাডি গ্রুপ যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি সেন্টারের সহায়তায় তিন বছরে ওই স্টাডি শেষ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাতে এর অবস্থান, প্রকৃতি ও মজুত সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। সেই ধারণা থেকেই বলা হচ্ছে, জরিপকৃত এলাকায় মজুত গ্যাস হাইড্রেট ১৭ থেকে ১০৩ টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের সমতুল্য। বাংলাদেশের মহিসোপানের সমগ্র এলাকায় সিসমিক জরিপ করা হলে সে মজুতের পরিমাণ আরও বেশি হবে।

৪.
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সমুদ্রসীমা) ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান, এই বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি ও মজুতের সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানির সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে তিনি আশাবাদী। সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলন প্রযুক্তি এখনও সহজলভ্য নয়। ফলে অনেক উন্নত দেশ এখনও এর উন্নয়ন বিবেচনায় নেয়নি।

৫.
আমাদের বিদ্যমান জ্বালানি উন্নয়ন নীতি ও কৌশল পর্যালোচনায় বলা যায়, নিজস্ব কয়লা এবং জল ও স্থলের গ্যাসের মজুত ও উত্তোলন অপেক্ষা এলএনজি, কয়লা, এমনকি তরল জ্বালানি আমদানি বৃদ্ধিতে আমরা বেশি মনোযোগী। অতীতে কয়লা ও গ্যাস মজুত সম্পর্কে গ্যাস হাইড্রেট মজুতের মতোই ধারণা জনগণকে দেওয়া হয় এবং দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছেও বলা হয়। ফলে সরকার গ্যাস রপ্তানির চেষ্টা চালায়। পরে এলএনজি হিসেবে সাগরের গ্যাস রপ্তানিরও চেষ্টা চলে। আবার গ্যাস দিয়ে তৈরি সার এবং কয়লা রপ্তানির চেষ্টা চলে। জনগণের বিরোধিতার মুখে এসব চেষ্টা সফল হয়নি।

৬.
বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমার অংশে তেল-গ্যাস আহরণ কর্মযজ্ঞ দেশ দুটিকে গ্যাসসম্পদে সমৃদ্ধ করেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ সাগরের সার্বভৌম অধিকার আদায় এবং জ্বলানি সম্পদে জনগণের শতভাগ মালিকানা সুরক্ষায় বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের তুলনায় যথেষ্ট তৎপর ও কার্যকর ছিল।

৭.
২০০১ সালের পর ভারতের সমুদ্রে, বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার এবং প্রায় একই সময়ে মিয়ানমার সমুদ্রে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার বঙ্গোপসাগরকে গ্যাসসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিতি দেয়। আন্তর্জাতিক আদালত ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি করে এবং চূড়ান্তভাবে সীমানা নির্ধারণ করে রায় দেন। ফলে বাংলাদেশ নিজস্ব সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণের পরিবেশ ফিরে পায়।

৮.
২০১৩ সালে মিয়ানমার তার সমুদ্র ব্লকগুলো চিহ্নিত এবং প্রাথমিকভাবে মাল্টি ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে সম্পন্ন করে। গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আইওসিদের কাছ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করে। ২০১৪ সালে ১০টি আইওসির সঙ্গে সম্পাদিত পিএসসির অধীনে মিয়ানমার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ শুরু করে এবং সমুদ্রের গ্যাস আহরণে অগ্রসর হয়। ভারতও তার সমুদ্রে অনুসন্ধান চালায় এবং আইওসির সহায়তায় গ্যাস আহরণে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করে।

৯.
সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ সমুদ্র ব্লকগুলোকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে ২৬টি ব্লকে ভাগ করে। ব্লকগুলোর মধ্যে ১১টি অগভীর এবং ১৫টি গভীর। ২৬টি ব্লকের মধ্যে বর্তমানে মাত্র চারটি ব্লক আইওসির অধীনে চুক্তিবদ্ধ। বাকি ২২টি ব্লক উন্নয়ন কার্যক্রম-বহির্ভূত। ২০১৪ সালে পেট্রোবাংলা সাগরবক্ষে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে মাল্টি ক্লায়েন্ট সিসমিক (এমসিএস) সার্ভে বা জরিপ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা সফল হয়নি।

১০.
এমসিএস জরিপ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সমুদ্রের মাটির নিচে ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গ্যাস থাকার সম্ভাবনার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এই জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশ কোনো আইওসিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আকৃষ্ট করতে পারে। এ কাজে আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত বহুজাতিক কোম্পানিকে নিয়োগ করা হয়। সুবিধাজনক হলে তারা বিনামূল্যেও এমসিএস জরিপ করে থাকে। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে 'ডেটা প্যাকেজ' তৈরি হয়, তা দেশটির তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আসতে আগ্রহী আইওসিদের কাছে বিক্রি করা হয়। এই বিক্রির অর্থে বিনামূল্যে জরিপের খরচের অর্থ উসুল হয় এবং উদ্বৃত্ত অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে উভয় পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। কোনো দেশ তার সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস সম্পদ আইওসির দ্বারা অনুসন্ধান করাতে চাইলে সমুদ্রের প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত (ডেটা প্যাকেজ) দ্বারা আইওসিকে আকৃষ্ট করতে হয়। সাধারণত আইওসি ব্যয়বহুল অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় না।

১১.
বাংলাদেশ এমসিএস জরিপ করার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। পেট্রোবাংলা ২০১৪ সালে এ জরিপের জন্য প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা যাচাই-বাছাই করে বিদেশি কোম্পানি মনোনীত করে এবং অনুমোদনের জন্য মনোনয়ন প্রস্তাব জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠায়। অনুমোদন ছাড়াই মনোনয়ন প্রস্তাব ফিরে আসে। পেট্রোবাংলা ২০১৫ সালে আবার যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারা বাছাইকৃত কোম্পানির মনোনয়ন প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জ্বলানি বিভাগে পাঠায়। এ প্রস্তাবও অনুমোদন হয়নি। উভয় প্রস্তাবের কোনোটিরই অনুমোদন না করার কারণ জানানো হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের প্রার্থী বাদ পড়ায় পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুমোদন ছাড়াই জ্বালানি বিভাগ থেকে ফেরত আসে। সাগরের গ্যাস অনুসন্ধান উদ্যোগ অনিশ্চয়তার শিকার হয় (সূত্র :বদরূল ইমাম, দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ জনুয়ারি ২০১৯)।

১২.
নিজেরাই জাহাজ কিনে সাগরে প্রয়োজনীয় জরিপ কাজ চালানোর ব্যাপারে পরে জ্বালানি বিভাগ নিজেই প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবটি অবাস্তব এবং অজ্ঞতাপ্রসূত- তা বুঝে উঠতে জ্বালানি বিভাগের বছরখানেক সময় লাগে। এর পর অপর এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ জাহাজ ও জনবল ভাড়া করে সাগর জরিপের মাধ্যমে ডেটা প্যাকেজ তৈরি করবে। সে ডেটা প্যাকেজ যে আইওসির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা বুঝতে জ্বালানি বিভাগের কত সময় লেগেছে জানা যায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত সাগরে গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়, জ্বালানি বিভাগ ডেটা প্যাকেজ তৈরি করতে পারেনি। পারলেও আইওসি আকর্ষিত হয়নি। তাই সাগরে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জনগণের সামনে আসতে সক্ষম হয়নি। অবশ্য গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা নিয়ে এসেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিকে বিপুল পরিমাণে গ্যাসপ্রাপ্তির ব্যাপারে আশাবাদী করতে। এ আশাও যে অবাস্তব এবং বিভ্রান্তিকর- তা বুঝতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কত সময় লাগবে, সময়ই বলবে। তবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় যে এখনই বুঝতে পেরেছে- জনগণের তা বুঝতে সময় লাগেনি।

ড. এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: