অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডে স্বজনদের তথ্য মিলেছে না
এম.এস রিয়াদ, (বরগুনা):
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ ও তার স্ত্রী ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় সুগন্ধা নদীতে প্রবেশের পরে এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে তারা ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইউএনও দম্পতি লঞ্চের ভিআইপি কেবিন নীলগিরির যাত্রী ছিলেন।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় তার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার ডান পা ভেঙে গেছে। বর্তমানে তিনি ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) সকালে বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ইউএনও জানান- ঢাকা থেকে অফিসিয়াল কাজ সেরে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। রাত ৩টার দিকে লঞ্চে অন্য যাত্রীদের চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে। এ সময় লঞ্চটি সুগন্ধা নদীর মাঝখানে অবস্থান করছিল। অনেকেই নদীতে লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন লঞ্চ থেকে তারাও লাফ দিলে তৃতীয় তলা থেকে দোতলায় পড়ে যান। তখন তার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার ডান পা ভেঙে যায় এবং হাতেও প্রচণ্ড আঘাত পান।
তিনি আরও বলেন, লঞ্চে থাকা বৃদ্ধ এবং শিশুরাই বেশি হতাহত হয়েছেন। এ ছাড়া লঞ্চে অনেক নারী ছিলেন, যারা নদীতে লাফিয়ে পড়েছেন।
এদিকে, নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দিতে পারছে না বরগুনা নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ।
রাজধানী ঢাকা থেকে পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের গাবখান চ্যানেলের কাছে সুগন্ধা নদীর মাঝখানে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে লঞ্চটি।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। কতজন নিখোঁজ আছেন, সে তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে লঞ্চে থাকা যাত্রীদের। তাই তাদের খোঁজে বরগুনা নৌবন্দরে এসেছেন লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা। কিন্তু এখানে এসে কোনো তথ্যই মিলছে না। নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই বরগুনা নৌবন্দরে।
বরগুনা নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ জানান- লঞ্চটিতে ৪-৫ শ' জন যাত্রী আরহণ করতে পারে। তাদের উদ্ধারে বরিশাল নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সাথে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঝালকাঠি ইউনিটের যুব সদস্যরা উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে কোস্টগার্ডসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
ইতোমধ্যে বরগুনা জেলা প্রশাসন থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক সহ কয়েক জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে রওনা করে গেছেন।
নৌ বন্দরের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।তবে যাত্রীদের নাম-ঠিকানা জানাতে পারেননি এই নৌবন্দর কর্মকর্তা।
অন্যদিকে- লঞ্চ দুর্ঘটনার পরপরই লঞ্চে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্বজনদের। তাই নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধানে বরগুনা নৌবন্দরে ভিড় করছেন স্বজনরা। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না, বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিতে পারছে না।
লঞ্চের যাত্রী সূত্রে জানা গেছে- আগুন লাগার পর অনেক যাত্রী প্রাণ বাঁচাতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন। এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করছেন লঞ্চ দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসা যাত্রীরা। তবে প্রাথমিকভাবে সঠিক কতটি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা এখনও জানা যায়নি।
বেঁচে ফিরে আসা দৈনিক জনবাণী পত্রিকার বরগুনা প্রতিনিধি সাংবাদিক সানাউল্লাহ জানান- লঞ্চটি ঝালকাঠি টার্মিনালের কাছাকাছি পৌঁছালে ইঞ্জিনরুমে আগুন লেগে যায়। সেই আগুন মুহূর্তেই পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠেছে বলে জানান।
সাংবাদিক সানাউল্লার পাশাপাশি এমভি অভিযান-১০ এর দুর্ঘটনা কবল থেকে বরগুনায় ফিরে এসেছে শহরের ক্রোক এলাকার বাসিন্দা বাবা রাজু আহমেদ, ছেলে হৃদয় (১২), মিম(৫), স্ত্রী মমতাজ, শহরের কাঠপট্টি এলাকার ছেলে মীর ফাইয়াজ, বন্ধু আশিক আহমেদ, রাইসুল আকরাম।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাউনিয়া সিকদার বাড়ির রিনা বেগম (৩৮) ও তার মেয়ে লিমা (১৪) নিখোঁজ রয়েছে। তবে লিমা বেগমের ছেলে কাউনিয়া এমদাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র রনি (১৫) লঞ্চ থেকে লাভ দিয়ে পড়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। বর্তমানে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়াও বরগুনার অধিকাংশ যাত্রীই বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুরি, বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ী, বামনা উপজেলার রামনা, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া সহ বিভিন্ন এলাকার। এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
বর্তমানে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ চালমান রয়েছে। উদ্ধার তৎপরতায় রয়েছেন- ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট এর ঝালকাঠি যুব সদস্য, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা।
তবে সচেতন মহল বলছেন- যথাযথ কর্তৃপক্ষের অপারগতা ও উদাসীনতায় এমন ধরনের দুর্ঘটনার মূল কারণ। কিভাবে ইঞ্জিন রুমের পাশে রান্নাঘর থাকে? আবার সেখানে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না করা হয়! বিষয়গুলো সত্যিই ভাববার বিষয়। এছাড়া অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কতটা পরিপূর্ণ তাও খতিয়ে দেখা উচিত।
এ নিয়ে নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের ব্যবস্থা না থাকার কারণেই এসব দুর্ঘটনা বারবার ফিরে আসছে। স্বজন হারানোর ব্যাথার কান্না করতে হচ্ছে অনেকেরই।
মহলটি আরও বলছেন- সরকারের তরফ থেকে সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে এমন ঘটনার স্থায়ী সমাধান করলে আর কখনো এ দুর্ঘটনা দেখতে হবে না।
এসএমটি