শিরোনাম

South east bank ad

৫০ বছরের স্বাধীনতা : সক্ষমতা অক্ষমতার খতিয়ান

 প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

একাত্তরে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের নজর কেড়ে বিস্ময় হয়েছিল। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সংক্ষিপ্ততম মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। ভারতের সাহায্য-অংশগ্রহণ বিজয়কে এগিয়ে নিয়েছিল ঠিকই; আবার এটাও ঠিক, ভারতের অংশগ্রহণহীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হতো। তবে আমাদের বিজয় অবধারিত ছিল। ব্যাপারটি যুদ্ধ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেই বোধগম্য হবে। আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জগজিৎ সিং অরোরা এমন অভিমত জানিয়েছিলেন। সমরবিদ অরোরার সঙ্গে সহমত পোষণ না করলেও তার মত তো উপেক্ষা করা অসম্ভব। লড়াকু বাঙালির বিজয় ছিল ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, যা ছিল তাদের সক্ষমতার প্রথম প্রকাশ। এ বিজয় রুখে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের গলদঘর্ম হওয়ার কাহিনি তো সবার জানা। বলা যায়, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ একাত্তরেই তার সক্ষমতা জাহির করেছিল।

আরও বলা যায়, যাত্রার শুরুতেই বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ বিশ্বকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তারা পারে। বোধগম্য, বঙ্গবন্ধু কেন তার মানুষকে এত ভালোবেসেছিলেন। নেতা-জনতার পারস্পরিক ভালোবাসার দ্রাবক রসে সিঞ্চিত হয়ে বাংলাদেশের প্রথম সক্ষমতার প্রমাণ তৈরি হয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশের জন্মই তার অন্তর্লীন সক্ষমতার প্রমাণ।

কিন্তু সক্ষমতা জাহির করার পরপরই শঙ্কা ভর করেছিল। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশি বা ভারতীয় সৈন্যের অবস্থান বাংলাদেশের মানুষের শঙ্কা তৈরি করেছিল দেশটির অস্তিত্ব নিয়ে। কিন্তু ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিশ্চিত করলেন। সেদিনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হলো, ‘শেখ মুজিব যখনই ঢাকা বিমানবন্দরের বাইরে পা দেবেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশ বাস্তব অবয়ব পাবে।’ আসলে ব্যাপারটি ছিলও তাই। বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে বৈরী চীন তো বাংলাদেশকে ভারতীয় ‘মাঞ্চুকো’ বলে বসল। স্মর্তব্য, মাঞ্চুকো ছিল মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের তাঁবেদার রাষ্ট্র (১৯৩১-৩২)। ’৭২-এর জুন পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান করার কথা ছিল। কিন্তু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে এবং বঙ্গবন্ধুর সনির্বন্ধ অনুরোধে ভারতীয় সৈন্য ১২ মার্চের মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়। এটা ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ।

রাজনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ ৯ মাসের কম সময়ে প্রণীত ’৭২-এর সংবিধান, যা তৃতীয় দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে সে সময়ে কীর্তিত হয়েছিল। রাজনৈতিক সক্ষমতার আরও একটি প্রমাণ ছিল; রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণকে দেওয়া, অবশ্য যার বাস্তব প্রয়োগ এত দিন পরও প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু এমন ধারা যে, সংবিধানে আছে, সেটাই তো রাজনৈতিক সক্ষমতার বড় পরিচয়।

কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সক্ষমতার সমান্তরালে অর্থনৈতিক সক্ষমতার কথা মোটা দাগে বলতে হয়। ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি লন্ডন ক্লারিজেস হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গিয়ে কী করবেন? দেশটি তো সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত।’ স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার মাটি ও মানুষ যদি থাকে, তা হলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াব।’ অর্থৎ বঙ্গবন্ধুর কল্পনায় ছিল ফিনিক্স পাখির মতো উত্থান, যা আজ বাস্তব সত্য। বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তকমা পেয়েছে। ২০১৬ সালেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলেছে। অথচ জন্মলগ্নে কিসিঞ্জারের অভিসম্পাত ছিল, দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হবে। বাংলাদেশ জন্মের সময়ে তলাবিহীন ঝুড়িই ছিল। বঙ্গবন্ধু ঝুড়ির তলা লাগিয়েছিলেন, ঝুড়িতে কিছু জমাও করেছিলেন; এখন তো ঝুড়ি যেন উপচে পড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বড় প্রমাণ পদ্মা সেতু। নাটুকে কর্মকা- করে বিশ্বব্যাংক যখন অঙ্গীকার করা অর্থায়ন প্রত্যাহার করল, তখন আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, আমরাই নিজের টাকায় সেতু বানাব। আবারও শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহসিকতার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন; তবে অর্থায়নের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষকে। কারণ তাদের করের টাকায় এ সেতু হলো। টাকা প্রধানমন্ত্রীর নয়, সরকারের নয়, এমনকি আওয়ামী লীগেরও নয়; জনগণের। কারণ তারাই তো সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি সূর্যালোকের মতো সত্য। এ খাতে সক্ষমতা নিয়ে আমরা আত্নগর্বী। কিন্তু যাকে বলে উন্নয়ন, তা এখনো বাংলাদেশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কারণ বৈষম্য আছে, যা ক্রমেই বাড়ছে। এক ভাগ মানুষের হাতে ষোলো ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত। মনে রাখা দরকার, উন্নয়ন মানে সমতাসহ প্রবৃদ্ধি। প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের পূর্বশর্ত, যা অর্জনে বাংলাদেশের সক্ষমতা নজর কাড়া।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির জন্য কীর্তিত; কিন্তু সমালোচিত তার দুর্বৃত্তায়িত, সহিংস, সাংঘর্ষিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে। আদর্শরিক্ত ক্ষমতাসীনের রাজনীতি ক্ষমতার দাম্ভিকতা প্রকাশে ব্যস্ত এবং ক্ষমতায় অবস্থান দীর্ঘায়িত করায় সচেষ্ট। বিরোধীরা ক্ষমতার প্রত্যাশায় গলদঘর্ম। অর্থাৎ রাজনীতি মানে এখন ক্ষমতানীতি। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন রাজনীতিহীন দেশ এবং তা রাজনীতির সংজ্ঞার্থ ও নিহিতার্থ অনুযায়ী। যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রায়ন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, তা লক্ষণীয়ভাবে উধাও। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষমতা দুঃখজনক।

অর্থনীতি আর রাজনীতির যে বৈপরীত্য, তা আমাদের অক্ষমতার দ্যোতক এবং তা এক অশনিসংকেত। অর্থনীতির সমান জঙ্গমশক্তি ধারণ করতে না পারলে রাজনীতি অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলবে। ক্ষমতাসীনের রাজনীতিও যে টালমাটাল, তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের ভেতরের দশা। আওয়ামী লীগ এখন আওয়ামী লীগ থাকতে কেন অক্ষম, তা তলিয়ে-খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ দলটি এদেশের প্রাচীনতম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল। বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা বামদলগুলো এখনো শক্তপোক্ত বিরোধী দল হতে পারেনি, যা গণতন্ত্রের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এটাও আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক অক্ষমতা। মোদ্দা কথা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর রাজনৈতিক অনুন্নয়নের মুখোমুখি আমরা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের সক্ষমতার দ্যোতক; আর রাজনৈতিক অনুন্নয়ন অক্ষমতার।

অক্ষমতা আছে আমাদের শাসনে, শিক্ষায় আর চিকিৎসা ব্যবস্থায়। বিগত ৫০ বছরের সক্ষমতা-অক্ষমতা আমাদের মিশ্র স্থিতিপত্র। আগামী ৫০ বছরে স্থিতিপত্রে সম্পদ বাড়াতে হবে, এমন একটি অঙ্গীকার থাকা চাই।

লেখক : ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: