বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর পড়ে থাকে অযত্নে
এস এম সামছুর রহমান, (বাগেরহাট):
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের দোসর রাজাকার বাহিনী বাগেরহাটের সবচেয়ে বড় গনহত্যাটি চালায় রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের ডাকরা গ্রামে। ওই বছরের ২১ মে পুরো ডাকরা গ্রামকে রাজাকাররা বধ্যভূমি করে তুলেছিলো।
গুলি ও জবাই করে তারা সেদিন দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়া কচুয়া উপজেলার শাাঁখারীকাঠি, বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলো ঘাট ও সদর উপজেলার কান্দাপাড়ায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের গুলি ও জবাই করে হত্যা করে রাজাকাররা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এসব স্থান চিহ্নত করে স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করে।
কিন্তু সারা বছর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে বাগেরহাটে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে চিিহ্নত এসব বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো। যা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে সচেতন মহলের। তাদের দাবী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন দিবস আসলেই শুধু ওই বধ্যভূমি, স্মৃতিস্তম্ভগুলো ধুঁয়েমুছে তাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দিবসের কয়েকদিন যেতে না যেতেই তা আমরা ভুলে যাই।
১৯৯৭ সালে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের তীরে ডাকবাংলো বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নত করে একটি ফলক উন্মোচন করা হয়। ফলক উন্মোচনের ২১ বছর পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছয় লাখ টাকা ব্যায়ে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়। যদিও সারা বছর এই বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ থাকে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীদের দখলে। এনিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন মহলের ক্ষোভ রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা নকীব সিরাজুল হক বলেন, পাক হানাদারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সেদিন বাগেরহাটের মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাগেরহাটের অসংখ্য মানুষ রাজাকারদের হাতে খুন হন। তাদের অযত্নে ত্যাগের জন্য আজ আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সরকার বধ্যভূমিগুলো চিিহ্নত করে সেখানে স্তম্ভ নির্মান করে তা সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু সেইসব স্থানগুলো বলতে গেলে সারা বছরই পড়ে থাকে অযত্নে অবহেলায়।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিব) বাগেরহাট জেলা শাখার সভাপতি ডা: মোশারফ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের তীরের ডাকবাংলোর বধ্যভূমিটি অন্যতম কসাইখানা হিসেবে পরিচিত। রাজাকাররা এখানে অসংখ্য মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে তার মরদেহ ভৈরব নদে ভাসিয়ে দেয়। সেই স্থানে স্মৃতিস্বম্ভ নির্মাণ করা হলেও প্রায়ই সময় অপরিস্কার থাকে স্থানটি।
এছাড়া যুদ্ধকালীন প্রায় পুরো সময় জুড়ে বাগেরহাট শহরের মদনের মাঠের ওয়াপদা রেষ্টহাউজ চত্তর, সুপারী পট্টির রসিক পরামাণিকের বাসভবন, মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের পিছনে নদীর ঘাটে, কচুয়া উপজেলার শাঁখারীকাঠি, মঘিয়া, কান্দাপাড়া বাজার, দেপাড়া, মুক্ষাইট, বিষ্ণুপুর, রনজিতপুর, চুলকাঠি, মোরেলগঞ্জের তেলিগাতি, তেতুলবাড়ীয়া, লক্ষিখালী, চিতলমারীর দশমহল, শরণখোলার বগীসহ অর্ধ শতাধিক স্থানে গণহত্যার ঘটনা ঘটে।
এইসবের বেশিরভাগ জায়গায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। তবে সেগুলো নিয়মিত দেখাশোনা করার লোক নেই বললেই চলে।
রামপাল উপজেলার পেড়ীখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ডাকরার যে স্থানে গণহত্যা চালনো হয়েছিল সেখানে ৭/৮ বছর আগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়। যা নিয়মিত দেখাশোনা করা হয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে।
কচুয়া উপজেলার বাঁধাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নকীব ফয়সাল অহিদ বলেন, শাঁখারীকাঠি যে গণহত্যা হয়েছিল সেই গল্প তার মুক্তিযোদ্ধা চাচার কাছে শুনেছেন। ওই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছিল। সেটা এখনও রয়েছে। তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তিনি বলে মাঝে মধ্যে এটা পরিস্কার করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বাগেরহাট জেলার সাবেক কমান্ডার শাহীনুল আলম ছানা বলেন, ১৯৭১ সালে রাজাকাররা বাগেরহাটে অন্তত সাতশ মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। বাগেরহাটের প্রায় সব বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারা বছর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে। কোন দিবস আসলেই সেগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তাতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।