শীতের আগমনে বদলাতে শুরু করেছে বান্দরবানের জনশূন্য
সোহেল কান্তি নাথ, (বান্দরবান):
করোনার কারনে দীর্ঘদিন পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় ধ্বস নামে জেলার পর্যটন খাতে। কিন্তু বিপর্যয় কাটিয়ে ধীরে ধীরে আবারো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পাহাড়ের পর্যটন শিল্প। শীত যেন আশির্বাদ হয়ে এসেছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের জন্য। শীতের আগমনে বদলাতে শুরু করেছে জনশূন্য পর্যটন স্পটগুলোর চিত্র। ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের আনাগোনা বেড়েছে দর্শনীয় স্থানগুলোতে। ধস কাটিয়ে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে চাঙ্গা হয়ে উঠছে পাহাড়ের অর্থনীতিও।
বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ খ্যাত পাহাড়ী জেলা বান্দরবান। পাহাড়ের স্নেহ ছায়ায় গড়ে উঠা এক স্বপ্নীল জনপদ। মহান স্রষ্টার উজাড় করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অফুরন্ত ভান্ডার বান্দরবান। নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং এ জেলায় বসবাস কারী বাঙালীসহ ১১ টি জাতি গোষ্ঠির অকৃত্রিম জীবনাচরণ যে কারো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বান্দরবানের এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের পদচারনায় মূখরিত থাকে বান্দরবানের পর্যটন স্পট নীলাচল মেঘলা প্রান্তিক লেক চিম্বুক নীলগিরি বগালেক নাফাকুম দেবতাকুমসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলো। শীতে কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা বান্দরবানের পাহাড় গুলো দূর থেকে দেখে মনে হয় বরফের স্তুপ। প্রকৃতি যেন সবটুকু উজাড় করে দিয়ে পেখম মেলে বসে আছে সৌন্দর্য্য বিকাশে আর শীত মৌসুমই হলো পাহাড়ী জেলা বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। যান্ত্রিক জীবনের নানা কর্মব্যস্ততা ভুলে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য শীত মৌসুমে ভ্রমন পিপাসুরা ছুটে আসে পর্যটন নগরী বান্দরবানে।
শীতের হিমেল পরশে সজীবতা এসেছে পাহাড়ের প্রকৃতিতে। শীত যেন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের আনা-গোনা বেড়ে যাওয়ায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে পাহাড়ের অর্থনীতিও। পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জীবন জীবিকা। জেলার আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হস্ত শিল্পের তৈরি শো-পিজ, কোমর তাঁতের কাপড়সহ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা গুলোর বেচা-বিক্রিও জমে উঠতে শুরু করেছে। পর্যটকবাহী গাড়িগুলোসহ পরিবহন ব্যবসাও অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে ক্ষতি কাটিয়ে উঠছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। হলি ডে ইন রিসোট ও ইকো সেন্স রিসোর্টের মালিক জাকির হোসেন বলেন পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেয়ার পর থেকে পর্যটকদের আনা গোনা বেড়েছে পর্যটন নগরী বান্দরবানে আমাদের বিজনেস আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে।
আশা করছি আস্তে আস্তে করোনার যে ক্ষতি হয়েছে সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের প্রাকৃতিক যে সৌন্দর্য্য সেটি সংরক্ষণ করা জরুরী পরিবেশ প্রতিবেশের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সরকারকে সেদিকে লক্ষ রাখা উচিৎ। কারন শীত মৌসুম আসলে ঝিরি ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয় গাছ কাটা শুরু হয়। এরফলে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয়। দেখা যাবে একসময় রেমাক্রী নাফাকুমের পানি শুকিয়ে গেছে। কারন রেমাক্রী নাফাকুমের সৌন্দর্য্য দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক আসে বান্দরবানে। তাই প্রকৃতি যদি সুরক্ষিত রাখা না যায় একসময় আর পর্যটক সৌন্দর্য্য দেখতে আসবে না। এছাড়াও আমাদের পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশটা ময়লা করে ফেলা হয় তাই সরকার পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করলে পরিবেশটা সুন্দর থাকবে।
স্বপ্ন বিলাস রিসোর্ট এর পরিচালক বিশ^জিৎ দাশ বাপ্পা বলেন- শীতের আগমনে বান্দরবানে পর্যটক বেড়েছে, যার ফলে আমাদের ব্যবসাও ভাল হচ্ছে। তবে পর্যটকদের জন্য এখানে সন্ধার পরে বিনোদনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই তাই তারা এখানে এসে বেশী দিন থাকতে চান না। পর্যটকদের জন্য সরকারী ভাবে বিনোদনের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করা হলে তারা বান্দরবান এসে আরো বেশী সময় কাটাতে পারত। আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির স্থানীয় পাহাড়ি ব্যবসায়ী লাল পিয়াম বম বলেন, পাহাড়িদের তৈরি কোমর তাঁতের পোষাক (কাপড়) এবং বাঁশ, কাঠের তৈরির হস্তশিল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্রের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে পর্যটক। বেড়াতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকেরাই এসব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়। শীতের সঙ্গে পর্যটকেরাও আসতে শুরু করেছে। মোটামুটি বেচা বিক্রিও ভাল হচ্ছে। এবার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো মনে করছেন পাহাড়ী ব্যবসায়ীরা।
বান্দরবান চাঁদের গাড়ি শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল বলেন, পর্যটকবাহী প্রায় তিনশ গাড়ি রয়েছে বান্দরবান। গাড়িগুলোর সঙ্গে জড়িত কয়েকশ শ্রমিক প্রায় ছয়মাস ধরে ভীষণ কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু শীত পড়তে শুরু করায় পর্যটকরাও আসতে শুরু করেছেন। তাদেরও ইনকামের রাস্তা খুলে গিয়েছে। রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, পর্যটকের ওপর এখানকার রেস্টুরেন্ট গুলোও অনেকটা নির্ভরশীল। পর্যটক আসায় রেস্টুরেন্ট গুলোতে আবারো বেচা-বিক্রি বেড়েছে।
বান্দরবান জেলা সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানান, পাহাড়ের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির অন্যতম খাত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। করোনার কারনে ধস নামে এখানকার পর্যটন শিল্পে। কিন্তু শীতের শুরুতে পর্যটকদের আনা-গোনা বাড়ায় আবারো ঘুরে দাড়াচ্ছে পর্যটন শিল্প। চাঙ্গা হয়ে উঠছে এ অঞ্চলের অর্থনীতিও। তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে বান্দরবানে আবাসিক হোটেলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট এবং হস্তে শিল্পের তৈরি শোপিজ, কোমর তাঁতের কাপড়ের দোকানসহ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। এছাড়াও সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত রিসোর্ট। শুধু জেলা শহর নয় বিভিন্ন উপজেলাতেও পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র এবং সেগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হোটেল মোটেল রিসোর্ট।
একসময় শুধু বান্দরবান জেলা শহরে পর্যটকদের থাকার জন্য হোটেল ছিল কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন উপজেলাতে পর্যটকদের থাকার সুব্যবস্থা হয়েছে। এরফলে পর্যটন খাত সম্প্রসারিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। বর্তমানে জেলায় ৭০ টি আবাসিক হোটেল-মোটেলে দৈনিক পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক আসে। পর্যটকদের সেবায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ জন কর্মী, পাঁচ শতাধিক ট্যুরিস্ট গাইড, পাঁচ শতাধিক গাড়ি চালক ও চালকের সহকারী এবং খাবারের দোকানের কর্মচারীদের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। সে হিসেবে পর্যটন খাতে প্রতিদিনই কমপক্ষে অর্ধ কোটি টাকার লেনদেন হয়। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেল অর্থ বছরে করোনার কারণে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল হোটেল ব্যবসা থেকে ১৫ লক্ষ টাকা। পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেয়ার পর পর্যটকের আগমন ঘটায় চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত হোটেল ব্যবসা থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৮ লক্ষ টাকা। তবে শীত মৌসুমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আরো বাড়বে বলেন জানান বান্দরবানের রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন করোনায় হোটেল মোটেল বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভাল হয়নি। কিন্তু এখন পর্যটক আসছে হোটেল ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও ভাল হচ্ছে শীত মৌসুম পর্যটন মৌসুম এসময় পর্যটকের আগমন আরো বেশী হবে আশা করি সরকারের রাজস্ব আদায় আরো বেশী হবে।