কৃষকের নবান্ন উৎসব বিপন্নের পথে
রাশেদুজ্জামান রাশেদ, (প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী) :
বাংলাদেশ শস্যের খনি একথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। কৃষি ও কৃষক মাত্র দুই টি শব্দ হলেও ওই শব্দ দুটোর মধ্যে জরিয়ে আছে পুরো বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ মানেই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলার কৃষিভিত্তিক সভ্যতার একটি দেশ। বর্তমানে কৃষকেরা মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কারণ হেমন্ত ঋতুতে অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আমন ধানের আগমন। কৃষককের উৎপাদিত সোনালি ধানের সোনালি দিন। বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন উৎসব। নবান্ন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এ উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। বিশেষ করে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। মাঠ ভরা ধানে সোনালি ছোঁয়া লাগলেই গ্রাম-বাংলায় বোঝা যেত যে নবান্ন আসছে। কবিদের কবিতার ছন্দ আর পালাগান, লোকনাট্য, কেচ্ছা-কাহিনী, ভাওয়াইয়া গান, লালনগীতি ও বাউল গানের আসর। নাচ আর গানে মুখরিত হতো মেলাপ্রাঙ্গণ। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে কেন পালাগান আর বাউল গানের আসর বিপন্ন? কুরুচিপূর্ণ অপসংস্কৃতি দিয়ে কেন মানুষকে মাতিয়ে রাখা হচ্ছে? কেন কৃষকের ঘরে আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে? ফেসবুক, ইউটিউব সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচারের নামে নারীদেরকে ভোগপিপাসা অথবা পণ্যের সাথে তুলা করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে মৌলবাদীদের আখড়া তৈরী হচ্ছে যার ফলস্বরূপ বর্ষবরণে হামলা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে বাঁধা, নবান্ন উৎসবকে হিন্দু সংস্কৃতি, সাম্প্রতিক সহিংসতা, করোনা ভাইরাস মুসলমানদের ওপর সংক্রমিত হবে না, করোনা টিকা দিলে নারী পুরুষ হবে আর পুরুষ নারী হবে ইত্যাদি কূপমণ্ডূক বক্তব্য দিয়ে যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে। তারাই সমাজের কাছে প্রিয় ব্যক্তি হয়ে যায়। তবে একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ধর্মীয় লেবাজ পড়া ব্যক্তি ধর্মের নামে বেশি অধর্মই বেশি করে। এদের বিষয়ে রাষ্ট্রকে সজাগ থাকতে হবে। আরও দৃঢ়তার সাথে সজাগ থাকতে হবে কৃষকের সংকট নিরসন জন্য। কারণ বর্তমানে কৃষাণ বধূকে আর ব্যস্ত দেখা যায় না নিজ হাতে চালের গুঁড়া দিয়ে আঁকা মাঙ্গলিক আলপনায়। চিড়া, মোয়া, নাড়ু পিঠা-পুলি, ক্ষীর-পায়েস ইত্যাদি কৃষাণীর রান্না ঘরে তেমন আর রান্না হয় না। যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না আমাদের গ্রামগুলো। শুধুমাত্র শহরের নাট্যশিল্পীরাই নবান্ন উৎসব কে জিইয়ে রেখেছেন। নবান্নের মেলায় পাওয়া যায় না আর বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মণ্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটি-বাঁশ-বেত কাঠের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এভাবে অসাম্প্রদায়িক নবান্ন উৎসব বিপন্নের পথে চলতে থাকলে নতুন প্রজন্ম ভুলে যাবে নবান্ন নামে আমাদের একটি উৎসব আছে। কৃষকের মনে কেন উৎসব নেই? বাংলাদেশের কৃষকেরা কেমন আছে? তারা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য কতটুকু পায়?শ্রমিকদের একত্রিত হয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায়, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আন্দোলন চলে প্রতিনিয়ত কিন্তু রাজপথে কৃষকদের সংগঠিত কোনো আন্দোলন চোখে পড়ে না। কৃষক আন্দোলন কেন গড়ে ওঠে না? কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী'র মত কৃষক আন্দোলের নেতা আজ দেশে বড় বিপন্ন। কে পারবেন কৃষকের অধিকার ছিনিয়ে আনতে। আমাদের দেশে শোষিতদের মধ্যে কৃষকদের সংখ্যা বেশি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্র কী পেরেছেন কৃষকের কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে? এদেশে ১৭ কোটির মানুষের মুখের অন্ন জোগান দেয় কৃষকরাই। তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সোনালি ফসল উৎপাদন করে তখন কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু কার্তিকের শেষ সপ্তাহ থেকেই যখন ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে তখন হঠাৎ কৃষকের মাথায় হাত কারণ ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে করে কৃষি খাতে উৎপাদন খচর ৩০- ৩৪ শতাংশ বেড়ে যাবে। সেচ খরচ বিঘাপ্রতি ৩০০ টাকা বাড়বে পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা, কৃষককে বাড়তি গুনতে হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে সারের কোনো সংকট নেই। গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ আছে। সারাদেশে ডিলারদের কাছেও সার আছে। তবুও কৃষকরা সার পাচ্ছেন না কেন? কালোবাজারি করে কৃষকের পকেট কাটতেছে। এর সুষ্ঠু তদন্ত রাষ্ট্রের করার কি প্রয়োজন নেই। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, গ্যাসসহ সকল নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কৃষকের মাথায় হাত এত কিছু বাজারের ঊর্ধ্বমুখী ফসল উৎপাদন করবে কীভাবে? যে কৃষক দেশের মানুষের খাবার জোগান দেয় সেই কৃষক আজ কত অসহায় ও অবহেলিত। কৃষকের নিরব কান্না দেখার কেউ নেই। আমাদের পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বর্ডারগার্ডসহ সকল প্রশাসনিক কাজে কর্মরত মানুষের জন্য রাষ্ট্র তাদের পেনশনের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু কৃষকদের পেনশনের ব্যবস্থা নেই কেন? যে কৃষক দেশকে বাঁচায় সেই কৃষক টাকার অভাবে সন্তানের লেখাপড়ার খচর দিতে পারেন না, চিকিৎসার অভাবে দিনের পর দিন হাসপাতে ভর্তি হয়ে থাকে। সেই কৃষকের ঘরে উৎসবের আমেজ থাকার তো কথা নয়। ফলে মৌলবাদী চক্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে বাঙালির নবান্ন উৎসব যেন বিপন্ন হওয়ার পথে। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি সরকারি ক্রয় কেন্দ্র চালু করে ধান, গম, পাট, আলুসহ অন্যান্য ফসল ক্রয় করতে হবে। ভূমিহীনদের নিবন্ধন কার্ড দিতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে লটারি মাধ্যমে নয় সরাসরি কৃষকদের কাছে কৃষি পণ্য ক্রয় করতে হবে। প্রত্যেক কৃষকদের উৎসব ভাতা দিতে হবে। গ্রামীণ রেশনিং ব্যাবস্থা চালু করতে হবে। উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ দিয়ে ক্ষেতমজুরদের বছরে ন্যূনতম ১২০ দিনের কাজের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে হলে কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সেই অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে।