টাঙ্গাইলে টাকার বিনিময়ে মিলছে মুজিব শতবর্ষের ঘর!
মো.আবু জুবায়ের উজ্জল, (টাঙ্গাইল) :
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌর এলাকার হিজলী গ্রামে ছোট একটি চায়ের দোকান রয়েছে আব্দুল খালেক মন্ডলের (৬৫)। নেই তার কোন জমি ও থাকার ঘর। ফুটপাতে রয়েছে তার ছোট একটি চায়ের দোকান । দীর্ঘদিন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে গত তিন মাস আগে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে উপহার হিসেবে তিনি ঘর পেয়েছে। ঘর পেয়ে খুশি হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এখন সেই ঘরই ‘মরার উপর খরার ঘায়’ পরিনত হয়েছে।
জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরীব অসহায় মানুষদের মাঝে জমিসহ ঘর উপহার দেন। এরই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডে হিজলী গ্রামে আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় ১০টি ঘর নির্মান করা হয়। দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। গত তিন মাস আগে ঘরগুলো উপকার ভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মোঃ সবদের মিয়া। ঘর পেয়ে উপকার ভোগীরা খুব খুশি হলেও কাউন্সিলর সবদের মিয়াকে আগামী এক বছরের মধ্যে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে এমন নির্দেশনা থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ওইসব উপকার ভোগীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২টি ঘর নির্মানের জন্য এলেঙ্গা পৌরসভায় কোন খাস জমি না থাকায় পৌর কাউন্সিলর মোঃ সবদের মিয়ার দখলে থাকা ১৮ শতাংশ জমিসহ ২০ শতাংশ জমি দেন। ইতিমধ্যে ১০টি ঘর নির্মান করে তা উপকার ভোগীদের মাঝে হস্তান্তরও করা হয়েছে। হস্তান্তরের পর কাউন্সিলর সবদের সকল উপকার ভোগীদের তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে প্রতি ঘরের জন্য দুই শতাংশ জমির মূল ৭০ হাজার টাকা এবং দলিল ও নির্মান করা ঘরের মালামাল আনানেওয়ার খরচের জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধান করে দেন। এতে সকলেই ঘর পাওয়ার খুশিতে রাজি হলেও এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে কেউ ৩০ হাজার টাকা আবার কেউ ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়েও দিয়েছেন। বাকি টাকা আগামী এক বছরের মধ্যে না দিতে পারলে সরকারের পাওয়া উপহার হিসেবে ঘরটি ছাড়ার ভয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
হিজলী গ্রামের আবুল হাশেম মিয়া জানান, আশ্রায়ন প্রকল্পের নির্মান করা ঘরের জমি কাউন্সিলর সবদেরের। তবে সবদের ওই জমি হায়াতপুর গ্রামের মোঃ খোরশেদ আলমের কাছ থেকে কিনেছিলেন। সেই ক্রয়কৃত জমিতে ১৮ শতাংশ খাস জমিও রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু গ্রামের প্রচলিত নিজের জমির সাথে খাস জমি থাকলে সেটি নিজেরই হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উপকারভোগী স্বামী পরিত্যাক্তা পারভীন বেগম। থাকেন তার একমাত্র মেয়ে পপিকে নিয়ে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সরকারের উপহার দেওয়া ঘরে। কিন্তু তার জমির মূল্য এবং দলিল ও অন্যান্য খরচ দেওয়ার সামর্থ নেই তার। এ কারনে তার ভাই শাহীন টাকা দিয়ে জমিটি ক্রয় করে দিয়েছেন। পারভীন বেগমের মেয়ে পপি জানান, তাদের কোন টাকা পয়সা, জায়গা-জমি নেই। তাই মামা টাকা দিয়ে দুই শতাংশ জমি কিনে দিয়েছেন। জমিটি মায়ের নামেই দেয়া হয়েছে।
আরেক উপকারভোগী সন্তোস জানান, তার সংসারে সদস্য সংখ্যা নয়জন। তার মা এবং মেয়ে দুইজনেই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ্য। মা এবং মেয়ের চিকিৎসার জন্য নিজের বসতবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এরপর অল্প মূল্যে নদীর পার ঘেষে তিন শতাংশ জমি ক্রয় করে ছোট একটি টিনের ঘর তৈরি করেন। সেই ছোট টিনের ঘরেই তার নয় সদস্যের বসবাস। এরই মধ্যে স্থানীয় কাউন্সিলর সবদের তাকে আশ্রায়ন প্রকল্পের একটি ঘর পাইয়ে দেন। বিনিময়ে ঘর নির্মানের জন্য দুই শতাংশ জমি শতাংশ প্রতি ৩৫ হাজার টাকা করে দিতে বলেন। এতেই তিনি রাজি হয়ে যান। এরই মধ্যে তিনি ৩০ হাজার টাকা দিয়েও দিয়েছেন। বাকি টাকা ধীরে ধীরে দিতে চেয়েছেন।
আব্দুল খালেক মন্ডল জানান, ঘর নির্মান করা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা নিয়েছেন কাউন্সিলর সবদের মিয়া। এর মধ্যে সাড়ে নয় হাজার টাকা জমি দলিল করার জন্য এবং বাকি টাকা ঘরের নির্মান সামগ্রী (ক্যারিং খরচ) আনার জন্য। আর দুই শতাংশ জমির মূল্য আগামী এক বছর পর দিতে হবে বলে তাকে কাউন্সিলর জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, আমরা জানতাম যাদের জমি নাই, ঘর নাই, সরকার তাদের ঘর দিচ্ছে। কিন্তু এখন আমার জমি কিনে সরকারের ঘর নিতে হচ্ছে। এত টাকা দিয়ে জমি কিনতে পারলে তো আর ঘর দরকার ছিল না। তিনি এই ঘর জমিসহ উপহার দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
এলেঙ্গা পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ সবদের মিয়া জানান, এলেঙ্গা পৌরসভায় ঘর নির্মানের জন্য সে সময় কোন খাস জমি ছিল না। তাই তৎকালিন ভূমি অফিসের নায়েবের পরামর্শে তিনি আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মানের জন্য জমি দেন। তবে উপকারভোগীদের কেউ ঘর নির্মানের জন্য দেওয়া দুই শতাংশ জমির মূল্য পরিশোধ করেননি। তবে দলিল এবং অন্যান্য খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
টাঙ্গাইলে কালিহাতী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মোঃ মোবাশের আলম জানান, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সরকার যে ঘরগুলো উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করেছেন সেগুলো জমি সহই করা হয়েছে। আর উপকারভোগীদের কাছ থেকে কেউ ঘর নির্মানের জন্য দুই শতাংশ জমির মূল্য নিয়ে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয় কাউন্সিলর সবদের মিয়ার ব্যাপারে ভাল করে ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে ।