তিস্তার অসময়ের বন্যায় ক্ষতচিহ্ন শুকায়নি, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় চরের মানুষ
আমিনুল ইসলাম জুয়েল, (রংপুর) :
দুই বিঘা জমিতে মরিচের চারা রোপণ করেছিলেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া গ্রামের সেকেন্দার আলী। চারা গাছগুলো দ্রুত বড় হচ্ছিল। বাজারে আগাম মরিচ বিক্রি করে লাভের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্তু তিস্তার আকস্মিক বন্যায় তার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এতে তিনি হতাশ হয়ে পড়লেও নতুন উদ্যোমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ক্ষেতে ক্ষতিগ্রস্ত চারার স্থলে নতুন করে মরিচের চারা রোপণ করছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক আশা করি মরিচ আবাদ করছিনু, গাছগুলা ডগডগ করি উঠছিল। কিন্ত বানের পানি আসি সউগ শেষ করি দিছে। এখন নয়া করি শুরু করছি বাহে। হামার এ্যাত্তি চারা পাওয়ায় যায় না, বগুড়া থাকি মরিচের চারা আনছি।’
শুধু তিনি নন, তিস্তার অসময়ের বন্যায় তার মতো রংপুরের পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলার নদী তীরবর্তী ৪৫ টি গ্রামের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলায় ৩০টি, কাউনিয়া উপজেলায় ১০টি ও পীরগাছা উপজেলার ৫টি গ্রাম হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে ডুবে যায়। পানি দ্রুত নেমে গেলেও ধান, আগাম আলু, মচির ও চিনা বাদামসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বন্যায় রংপুরের তিন উপজেলা গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছায় দুই হাজার ৫০৫ হেক্টর জমির রোপা আমন, ৩৫ হেক্টর জমির মরিচ, ৬২ হেক্টর জমির চিনা বাদাম ও ৪৮ হেক্টর জমির চিনা বাদাম পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এতে ৩৪৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৯ হেক্টর জমির আমন, মরিচ ৩০ হেক্টর, চিনা বাদাম ৬০ ও শাক সবজি ২৬ হেক্টর রয়েছে।
তবে কৃষি বিভাগের নিরূপণ করা হিসাবের সঙ্গে একমত নন কৃষকেরা। তারা বলছেন, অসময়ে তিস্তার আকস্মিক বন্যায় ক্ষতির পরিমান আরও কয়েক গুণ বেশী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর উজানের ঢলে তিস্তা অববাহিকায় বিপৎসীমার এ যাবতকালের সবোর্চ্চ রেকর্ড ভেঙে ৬০-৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। পানির স্রোতে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা। দুদিন পরই ফুলেফেঁপে ওঠা তিস্তার বুক থেকে পানি কমতে শুরু করে। এতে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
রোববার(৭ নভেম্বর) সকালে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তার আকস্মিক বন্যার পর পানি নেমে যাওয়ায় ক্ষতচিহ্ন ভেসে ওঠেছে। কোথাও কোথাও এখনও পড়ে আছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর। তিস্তার বালুতে চাপা পড়ে আছে কৃষকের ফসলী ক্ষেত। কৃষকেরা সেই বালু কাঁচি ও কোদাল দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছেন। আবার কোথাও পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন ফসল রোপণের কাজ করছেন তারা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এক মাসের মধ্যে বেশীরভাগ এলাকায় ধান কাটা মাড়াই শুরু হতো। এরই মধ্যে আকস্মিক বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয় ফসলী ক্ষেত। পানি সরে যাওয়ার পর ফসলে পচনও দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির উঠতি আমন, আগাম আলু, চিনাবাদাম ও শাক-সবজিসহ রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের হাগুড়িয়া হাশিম গ্রামের কৃষক সামছুল হক দুই একর জমিতে আমন ধান রোপন করেছিলেন। আর কয়েক দিনের মধ্যে ধান কাটা যেত। এমন সময় আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের।
তিনি বলেন, ‘হামার সউগ শ্যাষ হইছে বাহে। ধান ঘরে তুলতি না পারলে কেমন করি খামো।’
অন্য সময় বাজারে আলুর দাম যেমন থাকে, নতুন আলু বাজারে উঠলে তার দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে গত দুই বছর থেকে চরের কৃষকরা আগাম আলু চাষে ঝুঁকে পড়েছে। এতে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছে অনেক কৃষক। তবে এবার আগের বন্যায় তেমন ক্ষতি না হলেও অসময়ের আকস্মিক বন্যায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকে লাভের আশায় আধা পাকা ধান কেটে আগাম আলু রোপন করেছিল। আবার কেউ কেউ আগাম আলুর লাভ ঘরে তুলতে জমিতে ধানই রোপণ করেননি। বন্যার পানিতে তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পানি নেমে যাওয়ার পর তারা আবার আলু রোপণ করছেন।
আমিনুল ইসলাম নামে এক আলু চাষি বলেন, ‘গত বছর আগাম আলু চাষ করে লাভবান হয়েছি। এবারও রোপণ করেছিলাম। কিন্তু বন্যায় রোপণ করা আলু পচে গেছে। তাই আবারও ওই জমিতে আলু রোপন করতেছি।’
গঙ্গাচড়া উপজেলার চর পূর্ব ইচলির হাসান আলী বলেন, ‘ঋণ করে জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। কিন্তু বানের পানি নষ্ট করে দিয়েছে। এখন ঋণ শোধ করবো কি করে, আর খাবো কি।’
লক্ষ্মীটারীর কৃষক আরিফুল ইসলাম জানান, ‘আর কয়েক দিন পর ধান ঘরে তোলা যেত, সেই ধান বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে। এখন নতুন করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রবিশস্যের আবাদ করবো সেই টাকাও নেই।’
পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার চরে সকল ফসলের আবাদ ভাল হয়েছিল। আকস্মিক বন্যায় কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত এ সময়ে বন্যা হয় না। কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে কৃষি অধিদপ্তর থেকে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, রংপুরে রবি মৌসুমে ছয়টি ফসলের যে কোন একটির জন্য ৩৫ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার প্রায় ১০ হাজার কৃষক এই প্রণোদনার আওতায় আসবে। এতে কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন ফসলের সার ও বীজ সহায়তা দেওয়া হবে।