South east bank ad

আতঙ্কের নাম এএসএম কেমিক্যাল কারখানা যেন মৃত্যুপুরীতে গ্রামবাসীর বসবাস

 প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

ফয়সাল আহমেদ, (গাজীপুর) :

গাজীপুরের শ্রীপুরের ঘনবসতি পূর্ন একটি গ্রাম টেপিরবাড়ী। প্রায় অর্ধলাখ লোকের বসবাস এই গ্রামের মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষির উপর নির্ভর করে পরিচালিত হলেও এখন আর তা অবশিষ্ট নেই।

২০০০সালের পর এলাকার মানুষের জীবন মান উন্নয়ণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও এএসএম কেমিক্যাল নামক একটি রাসায়নিক কারখানা গ্রামটিকে এখন পরিণত করেছে মৃত্যুপুরীতে। কারখানার রাসায়নিকের প্রভাবে মানুষের জীবনের পথে তৈরী করেছে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সাথে বারবার অগ্নিকান্ডের কারনে তা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২০০৫ সালে টেপিরবাড়ী গ্রামে মাওনা-গফরগাঁও সড়কের পাশে এ কারখানাটি গড়ে উঠে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের বিষয়ে বিধিনিষেধ থাকার পরও এখানে নিয়ম মানা হয়নি। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা না থাকা, অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকা, ভূগর্ভস্থ পানির সাথে রাসায়নিক মিশ্রিত হয়ে যাওয়ায় এলাকার বসবাসরত মানুষের জীবন ও জীবিকা থমকে গেছে। মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। মারা যাচ্ছে বিভিন্ন গাছপালা। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকে রাসায়নিক বের হয়ে আসায় বিশুদ্ধ পানির অভাব এখন গ্রাম জুড়েই। গ্রাম ছেড়ে অনেকেই এখন আশাপাশে ভাড়া বাড়ীতে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করছে। স্থানীয়রা আরো জানান,এ রাসায়নিক কারখানার কারণে এই এলাকায় নিরাপদ পানির স্তর খোঁজতে ৪শত ফুট নীচে যেতে হয়। এতে একটি নলকুপ স্থাপনে কয়েকলাখ টাকা খরচ হয়।

কারখানায় হাইড্রোজের অক্সাইড প্ল্যান্টে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারী (বৃহস্পতিবার) আগুন লাগে। সেখানে ৩জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়। পরে গত ০৩নভেম্বর(বুধবার) ফের এই কারখানার ব্লিচিং পাউডারের গোডাউনে ফের আগুন লাগে। রাসায়নিক কারখানার এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিষাক্ত রাসায়নিক আশপাশে যেমন ছড়িয়ে পড়ে তেমনি এর ঝাঁঝালো গন্ধে কয়েককিলোমিটার এলাকায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরী হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রাম জুড়েই। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে মানুষের বসতবাড়ীতে ফাটল তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে এ রাসায়নিক কারখানার কারণে মানবদেহে কঠিন রোগ তৈরী হওয়ার ঝুঁকির কথা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

টেপিরবাড়ী গ্রামের খলিল মিয়া বলেন, মূলত সমস্যাটি শুরু হয়েছে গত ১যুগ ধরে। প্রথম অবস্থায় পানির সাথে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে আসে। নলকুপগুলো অচল হয়ে পড়ে। পরে কারখানার পক্ষ থেকে কয়েকটি বাড়ীতে নলকুপ স্থাপন করে দেয়া হয়। তবে এখন পুরো গ্রামটির অবস্থা খুব খারাপ। অনেকের বাড়ীতেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। দূর থেকে পানি আনতে হয়। এসব কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার অনিরাপত্তা তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে দুরে ভাড়া বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে নি¤œআয় ও শিল্পকারখানার মানুষরা বাধ্য হয়েই মৃত্যুর সাথে বসবাস করছে।

এই গ্রামেরই বাসিন্দা ইব্রাহীম মিয়া বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই আশাপাশে রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ে। সড়কের পাশ দিয়ে ড্রেন তৈরী করেছিল তারা। যেখান দিয়ে রাসায়নিকের গন্ধ পাওয়া যায়, সেখানের গাছপালা তো মরেই গেছে। আর জীববৈচিত্রের তো দেখাই নেই। রাতের বেলায় কারখানার নির্দ্দিষ্ট পরিবহনযোগে রাসায়নিক নিয়ে রাস্তার ধারে কোথাও বা খালের মধ্যে ফেলা হয়। এতে পরিবেশও যে ধ্বংস হচ্ছে।

নুরজাহান বেগমের ভাষ্য, এই রাসায়নিক কারখানা বন্ধের জন্য আমরা অনেক আন্দোলন করছি কিন্তু কাজ হয়নি। আর এখন আগুনের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। আগুণ লাগার পর দম বন্ধ হয়ে যায়। শিশুরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। চোখের সামনে আমরা বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্র ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছি । নিজেরা মারা যাচ্ছি কেউ তো আসছে না। নিজেদের হতাশার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এভাবে তিলে তিলে মারার চেয়ে একবারে গ্রামবাসীদের মেরে ফেললেই তো হয়ে যায়।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষনা কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন বলেন, এ কারখানাটি যখন অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তখন ঘনবসতি ছিল না। শিল্পকারখানার সৌজন্যেই আর এখন তা ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে কারখানাটির নিবন্ধন আমরা নবায়ন করিনি। তবে তার দাবী, নির্দ্দিষ্ট একটি জোন তৈরী করে রাসায়নিক কারখানার স্থানান্তর করা প্রয়োজন। ঘনবসতির্পূ এলাকায় তা হওয়ায় মানুষের জন্য এখন ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত।

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও পরিবেশ ইন্সস্টিটিউট পরিচালক অধ্যাপক ড.আকরামুল আলম বলেন, রাসায়নিক কারখানার বিভিন্ন ধরনের বর্র্জ্য বিভিন্ন ভাবে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে যাওয়ায় এলাকার মানুষের নলকুপগুলো মূলত ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। কেননা বিশুদ্ধ পানির অভাবে এলাকায় একটা বিপর্যকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে পারে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনিয়া নাসরিন বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক কারখানা স্থাপনতো মৃত্যুর সাথে বসবাসের মতো। এসব কারখানায় অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে রাসায়নিক বাহিরে বের হয়ে আসে। রাসায়নিক মিশ্রিত ঝাঁঝালো গন্ধ মানবদেহে ক্যান্সার ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের অন্যতম কারণ। এর সাথে অগ্নিকান্ডের কারণে এলাকায় বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে, রাসায়নিকের কারণে এসব এলাকায় এসিড বৃষ্টির সম্ভাবনা জাগছে। মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এসব কারখানা দ্রুত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নির্দ্দিষ্ট একটি জোনে নেয়া প্রয়োজন।

কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আশিবুর রহমান বলেন, আমাদের কারখানার কারণে ক্ষতি হচ্ছে তা এমন ভাবে যাবে না। কেননা আমাদের প্রতিষ্ঠানেও ৪শতাধিক লোক কর্মরত রয়েছে। কারো কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমরা পুরো নিয়ম মেনেই কারখানা পরিচালনা করছি। তবে এলাকার মানুষজন নানাভাবে সমস্যার কথা বলেন আমরা মানবিক দিক বিবেচনায় তা সমাধানের চেষ্টা করি।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন ভূইয়া বলেন, এই কারখানাটির পরিবেশের ছাড়পত্র রয়েছে, তবে তার নবায়ন নেই। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হওয়ায় তা মানুষ ও পরিবেশের উপর কিছুটা প্রভাব পড়বেই এটা স্বাভাবিক। তবে ইচ্ছে করলেই একটি কারখানা বন্ধ করে দেয়া যায় না। এখানে ইটিপি কাজে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ কেমিক্যাল উৎপাদন হচ্ছে। তবে যেন নিয়মের মধ্যে কারখানাটি পরিচালিত হয় সে জন্য নজরদারী করবো।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: