র্যাবের অভিযানে ১১ জন গ্রেফতার
বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম
র্যাবের অভিযানে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারী ভিকটিম উদ্ধার; দুটি পাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১১ জন গ্রেফতার।
এলিট ফোর্স হিসেবে র্যাব আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই আইনের শাসন সমুন্নত রেখে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষে অপরাধ চিহ্নিতকরণ, প্রতিরোধ, শান্তি এবং জনশৃংখলা রক্ষায় কাজ করে আসছে। প্রতারণার মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভনে নারী পাচারে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। জঙ্গীবাদ, খুন, ধর্ষণ, নাশকতা এবং অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি এসকল ঘৃণিত মানবপাচারকারী চক্রের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র্যাব সদা সচেষ্ট।
অতি সাম্প্রতিককালে মে ২০২১ মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও একজন মহিয়সী “মা” জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের নিকট হতে উদ্ধারের ঘটনা প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হলে পাচারকারী চক্রের কাল্লু-সোহাগ @ কাল্লু-নাগিন সোহাগ @ মামা-ভাগিনা @ কালা-নাগিন সিন্ডিকেটের ০৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব।
উল্লেখিত ঘটনাসমূহ দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার ফলে বেশ কয়েকজন মানব পাচারের শিকার ভিকটিম প্রতিকারের আশায় র্যাবের নিকট অভিযোগ করে। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-৪ এর একাধিক আভিযানিক দল গতরাতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও হতে ২২ জন নারী ও চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবনগর এলাকা হতে ০১ জন নারীসহ সর্বমোট ২৩ জন বিদেশ পাচার হতে যাওয়া নারী ভিকটিমদের উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় মানব পাচার চক্রের ০২টি চক্র। তন্মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা হতে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার চক্রের মূলহোতা (১) মোঃ কামরুল ইসলাম @ জলিল @ ডিজে কামরুল@ ড্যান্স কামরুল (৩৭), কুমিল্লা এবং তার চক্রের সদস্য (২) মোঃ রিপন মোল্লা (২২), চাঁদপুর, (৩) মোঃ আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০), গাজীপুর, (৪) মোঃ নাইমুর রহমান @ শামীম (২৫), ঝিনাইদহ এবং বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা হতে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের মূলহোতা (১) মোঃ নুর-নবী ভুইয়া রানা (৪৪), লক্ষীপুর, এবং তার চক্রের সদস্য (২) মোঃ আবুল বাশার (৫২), নোয়াখালী (৩) মোঃ আল ইমরান (৪১),লালমনিরহাট, (৪) মনিরুজ্জামান (৩৫), কুমিল্লা, (৫) মোঃ শহিদ সিকদার (৫৪), পিরোজপুর (৬) প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২), কুমিল্লা (৭) টোকন (৪৫), গোপালগঞ্জ’দেরকে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত অভিযানে জব্দ করা হয় ৫৩ টি পাসপোর্ট, ২০ টি মোবাইল, ০৮ বোতল বিদেশী মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, ০২ টি মোটর সাইকেল, ০১ টি ল্যাপটপ, ০১ সেট কম্পিউটার, ৯১,০৪০/- টাকাসহ মানব পাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচার চক্র।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পাশ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মোঃ কামরুল ইসলাম @ জলিল @ ডিজে কামরুল @ ড্যান্স কামরুল । এই চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ জন। ২০১৯ সাল হতে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচার মত অপরাধ করে আসছে। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী মেয়েদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ/ডেন্স শিখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। তাদেরকে বেপোয়ারা জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ফেলা হত। পরবর্তীতে তাদের পাশ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকুরীর কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো। এই ভাবে এই চক্রটি গত ২/৩ বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। মূলতঃ পাশ্ববর্তী দেশে অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায়, ভিকটিমদেরকে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের সাথে পাশ^বর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অতঃপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিত। এরপর থেকে ভিকটিমদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এই চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত ডিজে কামরুল।
গ্রেফতারকৃত মোঃ কামরুল ইসলাম , জলিল , ডিজে কামরুল, ড্যান্স কামরুল ২০০১ সালে কুমিল্লা হতে ঢাকায় পাড়ি জমায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সে বাড্ডা এলাকায় রিক্সা চালক হিসেবে জীবিকা শুরু করে। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানীর ডেলিভারী ভ্যান চালক হিসেবে কাজ নেয়। অতঃপর সে ড্যান্স গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সে হাতিরঝিল এলাকায় “ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম” নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে সে বিভিন্ন উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করত। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পাশ্ববর্তী দেশে পাচার করত। গ্রেফতারকৃত কামরুল ইসলাম জলিল বেশ কয়েকবার পার্শ্ববর্তী দেশে ভ্রমণ করে। পাশ্ববর্তী দেশের নারী পাচারকারী চক্রের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে সে তার ড্যান্স ক্লাবের ০১ নারীকে পাশ্ববর্তী দেশের বিউটি পার্লারে অধিক বেতনে চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। উক্ত ঘটনায় ভিকটিম এর বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করলে, সে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড্ডা থানা পুলিশ কর্তৃক আটক।