করোনায় সংসার জীবনে পা রেখেছে দেড় হাজার ছাত্রী
এম.এস রিয়াদ, (বরগুনা) :
বরগুনার তালতলীতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৫শ ১২ টি।
যে হাতে থাকবার কথা বই-কলম-খাতা, এখন সেই হাতে সংসারের হাড়ি-পাতিল-খুন্তি। যে বয়সে দুরন্তপনা করার কথা, সেখানে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে কোমলমতি শিশুদের।
টানা দেড় বছর করোনা মহামারীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অপরিণত বয়সে বিয়ের ঘটনা ঘটছে। দারিদ্র পীড়িত এ জনপদে কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবেই এখনো দেখেন অভিভাবকরা।
বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায় নারী ও শিশু নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগোনারীর তথ্যানুযায়ী ৭ মাসে এ উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের ১হাজার ৫শ ১২টি বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে।
বাল্যবিবাহের হার অনুযায়ী যথাক্রমে ১ নম্বরে আছে নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নে ৪৭০টি, ২য় অবস্থানে আছে বড়বগী ইউনিয়ন। সেখানে বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে ৪৬৪ টি, ৩য় অবস্থানে রয়েছে সোনাকাটা ইউনিয়ন। এটিতে ৩৪৪ টি এবং ৪র্থ স্থানে ছোটবগী ইউনিয়নে ২৩৪টি বাল্য বিয়ে সংগঠিত হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তায় জাগোনারীর ডোর টু ডোর জরিপে ৪ টি ইউনিয়নে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭ মাসের এ জরিপে বাল্যবিয়ের এমন তথ্য উঠে এসেছে। ফলে এ উপজেলার বাল্যবিয়ের হার বাস্তবতার আলোকে আরও অনেক বেশি বলে আশংকা করছেন গবেষকরা।
নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর লোকেরা গৃহস্থালীর আয় কমে যাওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায় ধসসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। এসব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চ সংখ্যক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটিয়েছে। বাল্যবিয়ের দৃশ্য উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে হরহামেশাই ঘটছে।
উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত পায়রা, আন্ধার মানিক নদী। আর এসব নদীর চরাঞ্চলে প্রাইমারী কিংবা উচ্চ বিদ্যালয়ের গন্ডি পাড় হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে এমন কোমলমতি মেয়ে শিশুদের।
প্রত্যন্ত এসব চরাঞ্চল গুলোতে ধর্মীয় চিন্তা, কুসংস্কার ছাড়াও অভাব অনটন, দারিদ্র্যতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। কন্যা শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা, মেয়ের বয়স বাড়লে বাড়ে যৌতুকের টাকার পরিমাণ, কম বয়সী মেয়েদের প্রতি বরের চাহিদা বেশি, যৌতুকের পরিমাণও কম লাগে ইত্যাদির কারণে বাল্যবিবাহের প্রবনতা অনেক বেশি বলে ধারনা করছেন মাঠ পর্যায়ের গবেষকরা।
বড়বগী ইউপি চেয়ারম্যান মো.আলমগীর মিঞা বলেন- বাল্য বিয়ের খবর পেলে পিতা-মাতাকে নিষেধ করলেও তারা গোপনে বিয়ে দিচ্ছেন। আর ভুয়া সনদে এসব বিয়ে পড়ালেও পরবর্তীতে দেখা যায় মেয়ের অভিভাবকরাই বিপদে পড়েন। যৌতুকের টাকা কিংবা অভাবের কারণে বাল্যবিয়ের বিচ্ছেদ ঘটছে অহরহ। কাজীরা বাল্যবিয়ে পড়ানোর কারণে বিয়ের আসল কাগজপত্র দেয় না। ফলে আইনি সহযোগিতা থেকেও মেয়ের অভিভাবকরা বঞ্চিত হয়।
নিশান বাড়িয়া ইউনিয়নের কাজী ও ইউপি সদস্য মো.মহিবুল্লাহ বলেন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বয়স লুকিয়ে অন্য উপজেলায় অথবা মৌলভী ডেকে বিয়ে পরানো হয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কাওছার হোসেন বলেন- তালতলী গরীব এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল। এ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শিক্ষাব্যবস্থা খুব দুর্বল। ফলে অন্যান্য এলাকার চেয়ে এই এলাকায় বাল্যবিয়ের প্রকোপ বেশি। তারপরও আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কাজী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীদের নিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন- তালতলী উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। যার কারনে আমরা অনেক সময় খবর পাইনা। আবার খবর পেয়ে আমরা যেতে যেতে বিয়েটা হয়ে যায়। তবে বাল্যবিয়ের হার গত বছরের পর ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে পরিবার থেকে সচেতন হওয়া যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করবে বলে আমি মনে করি। কেবল দরকার কাউন্সিলিং।