আজ প্রবীণ দিবস : সন্তান থেকেও নেই, ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে
আমিনুল ইসলাম জুয়েল, (রংপুর) :
স্বামী মারা গেইছে অনেক আগে। নিজে খায়া না খায়া ছয় ব্যাটা-বেটিক মানুষ করি বিয়া সাদি দিছোম। বিয়ের পর সগায় এ্যালা ভিন্ন (আলাদা) হয়া গেইছে। মোর খবর আর কেউ নেয় না। ব্যাটার বউরা কয় ওমরায় ছইল পইল (সন্তান) নিয়া ঠিকভাবে খাবার পায় না, মোক কোনটে থাকি খাওয়াইবে। মেয়েগুলার অবস্থাও ভালো না। সবার অভাব। বাধ্য হয়া এই বৃদ্ধাশ্রমোত চলি আসছি। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে পড়তে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধা মল্লিকা বেগম।
ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধার ঠাঁই হয়েছে দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।রংপুরের পীরগাছা উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে এবং রংপুর-সুন্দরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কৈকুড়ী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপাড়া গ্রামে এই বৃদ্ধাশ্রমের অবস্থান। ইতিহাসখ্যাত দেবী চৌধুরাণীর নামে পরিচিত দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। এখানে বর্তমানে মল্লিকা বেগমের মতো ভাগ্যতাড়িত অসহায় ২৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পেয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়।
শুক্রবার(০১ অক্টোবর) সকালে সরেজমিনে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রিতরা কেউ কেউ বসে গল্পে মেতে আছেন, কেউবা নামাজ পড়ছেন। আবার কেউ পত্রিকা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে নতুন কাউকে আসতে দেখলেই এসব মানুষের চোখে মুখে আনন্দ ভেসে ওঠে। তারা ভাবেন, তাদের কেউ হয়তো খোঁজ নিতে এসেছেন। নয়তো পরিবারের লোকজন বা আত্মীয়স্বজন এসেছেন মনে করে ছুটে যান তারা।
বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা নুরজাহান বেগম। স্বামীকে হারিয়েছেন ৪০ বছর আগে। কষ্ট করে ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা ঢাকায় কাজ করেন। বাড়িয়ে ছেলের বউ থাকলেও তার খোঁজ খবর নেয় না।
নুরজাহান বেগম বলেন, ‘এ্যালকার বউরা তো শ্বশুর-শাশুড়িক দেইখপার পায় না। বেটিরা থাকিয়াও নাই, তারা তো পরের বাড়িত থাকে। মোক দেখার কেউ নাই। যে কয়দিন বাঁচি আছোম, এ্যাটেই থাকিম।‘
আমেনা বেগমের স্বামী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। একটি ছেলে থাকলেও মায়ের খোঁজ নেয় না। বাধ্য হয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
আমেনা বেগম বলেন, ব্যাটা একটা আছে, কিন্তু থাকিয়াও নাই। মই বিধবা মানুষ ব্যাটার(ছেলের) সংসার ছাড়িয়ে এ্যাটে থাকা নাগবে মুই জীবনেও ভাবো নাই।
ছেলে মেয়ে থাকাতেও অনেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এ কথা ভেবে মনে কোন আক্ষেপ নেই নি:সন্তান জমিলা বেগমের। তিনিও বাবার বাড়ি ছেড়ে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি বলেন, সারা জীবন ভেবেছি ছেলে মেয়ে থাকলে এতো কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু এখনে এসে দেখলাম ছেলে-মেয়ে থেকেও অনেকের মনে শান্তি নেই। এখানে যারা আছে তাদের বেশির ভাগের ছেলে মেয়েরাই দেখাশুনা করে না।
শুধু মল্লিকা, নুরজাহান, আমেনা ও জামিলা নয়, তাদের মতো অনেকেই আছেন দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। তারা পরিবারে আশ্রয় না পেলেও বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পেয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়। তবে তাদের সবার মধ্যেই একসময় ছিল দুবেলা-দুমুঠো ভাত, কাপড়, ওষুধ আর সেবাযতœ না পাওয়ার অভাব। পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রিতদের সেই অভাব পূরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক রাজেকা রহমান। স্থানীয় প্রশাসন, সমাজসেবী ও দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে ব্যয় হয় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তবে কখনো কখনো রাজেকার বেতনের সঙ্গে স্বামীর ব্যবসার টাকাও জোগান দিতে হয়।
২০১৫ সালে গড়ে তোলা হয় দেবী চৌধুরাণী বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। নিজ উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিমাকর্মী রাজেকা রহমান। বর্তমানে সেখানে ২৫ জন অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। তাদের থাকা-খাওয়াসহ দেখাশোনা সবই করছেন রাজেকা রহমান।
তিনি বলেন, সন্তান থাকার পরও ঘরহীন, আশ্রয়হীন এসব মানুষকে চিন্তা তাড়িত করে। আমি সব সন্তানের প্রতি অনুরোধ করব, মা-বাবাকে কষ্ট দেবেন না। যত কষ্টই হোক মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জীবনটা উপভোগ করুন।