দুর্নীতিতে জড়িয়েও বহাল তবিয়তে ইউপি চেয়ারম্যান
আমজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী ব্যুরো) :
নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যরা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনস্থা দিয়েছিলেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন। তদন্তে সেই অভিযোগের সত্যতাও মিলেছিল। তারপর তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে সেই আদেশের স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে এখন তিনি বহাল।
সদস্যরা এখন আবারও বলছেন, চেয়ারম্যান এখনও স্বেচ্ছাচারিতা করে যাচ্ছেন। ডুবে আছেন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে। হটলাইনে অভিযোগ পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের একটি দল সবশেষ বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) পাকড়ি ইউনিয়নে এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছে। এতে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাকিব সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।
রাতে দুদকের ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এলজিএসপি এবং কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পের কাজ না করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন এতে নেতৃত্ব দেন।
দুদক টিম সরেজমিনে নিরপেক্ষ প্রকৌশলীর সহায়তায় দৈবচয়ন ভিত্তিতে কয়েকটি প্রকল্প পরিদর্শন করে। এরমধ্যে কবরস্থানের দেয়াল নির্মাণ, মাটি ভরাট, কবরস্থানের যাওয়ার রাস্তা নির্মাণ, সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন কাজ পরিদর্শন করে। এ সময় কয়েকটি প্রকল্পে কিছু অনিয়মের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া দুদক টিম জনগণের কাছ থেকে ইউনিয়ন পরিষদের কর আদায়ের কয়েকটি রশিদ পরীক্ষা করে। প্রাথমিকভাবে এসব রশিদ ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথি এবং কর আদায়ের রশিদ সংগ্রহ করেছে দুদক। সংগৃহীত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথিপত্র বিশ্লেষণ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে এনফোর্সমেন্ট টিম।
এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ইউপির ১১ জন সদস্য লিখিতভাবে ২২ ধরনের অভিযোগ করেছিলেন। ইউএনও কার্যালয়ে এসব অভিযোগের শুনানির সময় ইউপি সদস্যরা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থাও প্রকাশ করেন। সদস্যরা অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যানের পরিবারের মাত্র দুজন সদস্যের কবর রয়েছে এমন একটি জায়গাকে পারিবারিক কবরস্থান ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ বার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এই কবরস্থানে।
এই দশবার বরাদ্দের মধ্যে পাঁচবারই সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য। এ ছাড়া দুইবার রাস্তা ও একবার সোলার প্যানেল স্থাপনের নামে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে কবরস্থানটিতে। একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেখিয়ে একই রাস্তায় একাধিকবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নানা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেন চেয়ারম্যান রাকিব সরকার।
পরবর্তীতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুব্রত কুমার সরকার তদন্ত করে ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, রাজস্ব আয় হলেও ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর থেকে সদস্যদের ইউনিয়ন পরিষদের বেতনের অংশ পরিশোধ করা হয়নি। এ ছাড়া আরও নানা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। গত বছরের ৩ নভেম্বর গোদাগাড়ীর ইউএনও তদন্ত প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠান। সেটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গেলে গত মার্চে চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা হয়। শূন্য ঘোষণা করা হয় ইউপি চেয়ারম্যানের পদ।
তবে উচ্চ আদালতে গিয়ে তিনমাসের জন্য বরখাস্তের স্থগিতাদেশ আনেন রাকিব সরকার। এরপর তিনি দায়িত্বে ফেরেন। পরে বরখাস্তের স্থগিতাদেশের সময়সীমা আরও বাড়িয়ে আনেন উচ্চ আদালত থেকে। এখনও তিনি দায়িত্বে। এরই মধ্যে এই ইউপির নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হয়েছে। রাকিব সরকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আগামী নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবার জন্য চেষ্টা শুরু করেছেন।
পাকড়ি ইউপির ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জালাল উদ্দীন বলেন, চেয়ারম্যান আবদুর রাকিব সরকার হাইকোর্ট থেকে বহাল হয়ে আসার পর আরও বেপরোয়া হয়ে গেছেন। সদস্যদের গুণার তাঁর সময় নেই। যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছেন। উচ্চ আদালত থেকে বরখাস্তের স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে তিনি আবার দুর্নীতি করেছেন। দুদকের অভিযানেই তা প্রমাণিত হয়েছে। এমন লোক যেন আর চেয়ারম্যান না হন।
জানতে চাইলে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চেয়ারম্যান আবদুর রাকিব সরকার। তিনি বলেন, কোন দুর্নীতি হয়নি। গত বুধবার দুদকও কোন দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি। তবে চেয়ারম্যানের নানা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দুদক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে। অবশ্য দুদকের স্থানীয় কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চাননি।