নাব্যতা সংকট ও অতিমাত্রায় আহরণের কুফল: বলেশ্বর নদে মিলছে না সুস্বাদু রূপালি ইলিশ
নইন আবু নাঈম,(শরণখোলা):
বলেশ্বর নদের ইলিশের জুড়ি নেই! যেমন তার স্বাদ, তেমন তার রূপ। সমুদ্র বা অন্যান্য এলাকার ইলিশের থেকে একটু ব্যতিক্রম বলেশ্বরের ইলিশ। এর গড়নে রয়েছে এক রাজকীয় ঐতিহ্য। পিঠের ওপরের অংশটা ধূসর (গাঁড়ো ছাই রঙ) আর পুরো শরীরটা রূপালি। চওড়া পেটির এই ইলিশ খুবই দৃষ্টিনন্দন। বাগেরহাটের শরণখোলার বলেশ্বর নদের ইলিশের স্বাদ একবার যে পেয়েছে তাকে আবার আসতেই হবে এই ইলিশের খোঁজে।
সকালে জেলেরা বলেশ্বর নদে জাল ফেলে বিকেল থেকেই আসতে শুরু করে তাজা চকচকে ইলিশ নিয়ে। সারাবছরই ইলিশ পাওয়া যেত এই নদে। কিন্তু, সেই বলেশ্বরে এবছর সুস্বাদু ইলিশের প্রাচুর্জ নেই। জেলেরা দিনরাত সমানে জাল ফেলেও সেই ইলিশের দেখ পাচ্ছে না। আর যা সামন্য জালে ধরা পড়ছে তার বেশিরভাগই ছোট সাইজের (জাটকা)। কালেভদ্রে উঠছে দু-একটি বড় ইলিশ। তার দামও আকাশ ছোঁয়া। তাছাড়া, বঙ্গোপসাগরেও এবার কাঙ্খিত পরিমান ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। যে কারণে সাধরণ মানুষ ইচ্ছে করলেই গ্রহন করতে পারছে না এবছর ইলিশের স্বাদ। কারো বাড়ি মেহমান এলে ওই জাটকা (ছোট ইলিশ) দিয়েই ইলিশের স্বাদ মেটাতে হচ্ছে। এ যেনো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা।
বলেশ্বর হচ্ছে বঙ্গোপসাগর বিধৌত মিঠা পানির একটি নদ। সাগর কাছে হলেও অতিমাত্রায় কখনোই লবণাক্ত হয় না এই নদের পানি। সাগর থেকে সরাসরি ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠে আসে এখানে। একসময় ইলিশের অঘোষিত অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত ছিল এই বলেশ্বর নদ। কিন্তু ধীরে ধীরে কমে আসছে ইলিশের সংখ্যা। সাগরের নোনা পানি থেকে উঠে আসা এই ইলিশগুলো বলেশ্বরের মিঠা পানিতে অবস্থান করায় সাগরের ইলিশ একসময় বলেশ্বরের ইলিশে রূপান্তরিত হয়। এর রঙ, স্বাদেও আসে পরিবর্তন। যার ফলে, ভোজন রসিকদের কাছে এই ইলিশের চাহিদাও ব্যাপক।
বলেশ্বর নদের পারেই অবস্থিত রায়েন্দা বাজারে সান্ধ্যকালীন জমজমাট হাত বসে ইলিশের। বিকেল থেকেই অপক্ষো করতে থাকে ইলিশ পিপাসুরা। দু-একটি মাছ উঠলেই কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয় ক্রেতাদের। এতে একদিকে মাছের স্বল্পতা অন্যদিকে ক্রেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় মাছের দামও বেড়ে যায় দেড় থেকে দুইগুণ। সামুদ্রিক ইলিশ কম আসাতেও স্থানীয় ইলিশের দাম এতোটা চড়া।
শুক্রবার (২৭ আগস্ট) রায়েন্দার সান্ধ্যকালীন ইলিশের হাট ঘুরে আবুল বাশার নামে এক বিক্রেতার ডালায় ছোট মাছের সঙ্গে মাত্র তিনটি বড় ইলিশের দেখা মিলেছে। এর মধ্যে একটির ওজন এক কেজি ৭০০ গ্রাম। বাকি দুটির একটি এক কেজি, অন্যটি ৯০০গ্রাম। এছাড়া, অন্যান্য বিক্রেতাদের কারো ডালায় পাঁচ কেজি, কারো ডালায় সাত কেজি করে ছোট ইলিশ দেখা গেছে।
ইলিশ ব্যবসায়ী আ. হালিম খান জানান, তিনি সারা বলেশ্বর ঘুরে মাত্র সাত কেজি ইলিশ পেয়েছেন। এর মধ্যে একটিও কেজি সাইজের নেই। সবই জাটকা এবং চার-পাঁচ শ গ্রাম ওজনের। তিনি জানান, এবছর ইলিশ কম হওয়ায় জেলেদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এক হাজার গ্রাম বা তার ওপরের সাইজের এমন ইলিশের প্রতি কেজি নদীতে কেনা পড়ে ১৩ শ থেকে ১৪শ টাকায়। খুচরা বাজারে তারা বিক্রি করেন ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা কেজি দরে। ৬০০গ্রাম থেকে সাড়ে ৯শ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি কেনা দাম গড়ে ৯০০টাকা করে। বিক্রি হয় এক হাজার থেকে ১২শ টাকা দরে। ৩০০ থেকে ৬০০গ্রামেরটা কেনা প্রতি কজি গড়ে ৫০০টাকা করে আর বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৭০০টাকায়। এছাড়া ৫-৬টায় এক কেজি হয় এমন জাটকা ইলিশ কেনা গড়ে আড়ই শ থেকে তিন শ টাকায়। বিক্রি হয় সাড়ে তিন শ, চার শ টাকা দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরণখোলার পূর্ব খোন্তাকাট, রাজৈর, রায়েন্দা, জিলবুনিয়া, কদমতলা, রাজেশ্বর, তাফালবাড়ী, উত্তর সাউথখালী, গাবতলা, বগী, মোরেলগঞ্জের সন্ন্যাসী, কুমারখালী এবং মঠবাড়িয়ার তুষখালী, কাটাখাল, মাছুয়া, সাপলেজা ও মাঝের চরের প্রায় পাঁচ হাজার জেলে বলেশ্বর নদে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে। বর্তমানে মাছ না পেয়ে তারা সংকটে পড়েছে।
শরণখোলার কদমতলা গ্রামের জেলে ইমরান খান জানান, নদীতে জাল ফেলে খালি হাতে ফিরতে হয়। তেল খরচও ওঠেনা। তাই গত চারদিন ধরে নদীতে যান না। রুবেল হাওলাদার জানান, শুক্রবার সকালে নদীতে জাল ফেলে বিকেলে তুলে মাত্র দুই কেজি ৭০০গ্রাম ছোট ইলিশ পেয়েছেন।
স্থানীয় জেলেরা জানান, আগে বলেশ্বর নদে জাল ফেললেই প্রতিদিন ছোটবড় মিলিয়ে একেক নৌকায় ২০-২৫ কেজি করে ইলিশ পাওয়া যেতো। বলেশ্বরের বিভিন্ন অংশে এবং সাগর মোহনায় অসংখ্য চর পড়েছে। যার ফলে পানি এবং ¯্রােত কমে গেছে। তাই সাগর থেকে ইলিশ আসতে পারছে না। তাই নদীটি খনন করা হলে গভীরতা বাড়তো এবং আবার আগের মতো ইলিশ পাওয়া যেত।
বলেশ্বর নদে ইলিশের আধিক্য দিন দিন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, এর পেছনে বেশ কিছু যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। এর মধ্যে নাব্যতা সংকট, সাগরের তলদেশ ভরাট হওয়ায় ইলিশের গতি ও অবস্থান পরিবর্তন, খাদ্য সংকট, অতিমাত্রায় অপরিকল্পিত আহরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা কারনে ইলিশ কমে যেতে পারে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল আরো বলেন, ইলিশের প্রাচুর্জতা বাড়াতে হলে প্রথমে নদী খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপশি বলেশ্বর নদকে অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হলে সারাবছরই এখানে ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যাবে। তাছাড়া, ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই চ্যানেলে অতিরিক্ত পাঁচ শ জেলে মাছ ধরতে পারে। কিন্তু সেখানে জেলের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এটা ইলিশ সংকটের অন্যতম একটি কারণ।