জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঠাকুরগাঁওয়ের একমাত্র বক্ষব্যাধি ক্লিনিক!
ফরিদুল ইসলাম রঞ্জু, (ঠাকুরগাঁও) :
জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঠাকুরগাঁওয়ের একমাত্র বক্ষব্যাধি ক্লিনিকটি। চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তাছাড়া ক্লিনিকের প্রবেশপথে গেট ও নৈশপ্রহরী না থাকায় অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
ঠাকুরগাঁও জেলা শহরের সত্যপীর ব্রিজ–সংলগ্ন ১৯৬৪ সালে ৩ দশমিক ৩৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ক্লিনিকটি। মাত্র একজন মেডিকেল চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে চলছে এই ক্লিনিকের সেবাদান কার্যক্রম।
যক্ষ্মার লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার জগন্নাথপুর এলাকার বৃদ্ধ আবুল হোসেন জানান, তিনি গত তিন সপ্তাহ ধরে কাশিতে ভুগছিলেন। শনিবার যক্ষ্মা ক্লিনিকে পরীক্ষা করাতে এসে দেখেন রোগীদের লম্বা লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টের পর যখন ডাক্তার দেখলেন, তখন তিনি কিছু পরীক্ষা আর এক্স-রে করতে দিয়েছেন। এর জন্য তিনি তিন কিলোমিটার দূরে শহরের সরকারপাড়ায় ব্র্যাক কার্যালয়ে গিয়ে বুকের এক্স-রে করিয়ে নিয়ে এসে দেখেন চিকিৎসক নেই। সেবা কার্যক্রমের সময় শেষ হওয়ায় চিকিৎসক চলে গেছেন।
শহরের হাজীপাড়ার বাসিন্দা আঞ্জুমান বেগম নামে এক সমাজকর্মী কিছুদিন আগে তাঁর মায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন এই ক্লিনিকে। কিন্তু সেখানে এম টিআর টিবি চিকিৎসার সরঞ্জাম না থাকায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে রাজশাহী জেলার যক্ষ্মা হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়। পরে এক মাস সেখানে থেকে সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, ‘এই ক্লিনিকে নেই কোনো এক্স-রে মেশিন, নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ক্লিনিকের পর্যাপ্ত জায়গা থাকার পরেও এটি হাসপাতালে রূপান্তরিত হতে পারছে না, যার কারণে এম টিআর টিবির মতো জটিল যক্ষ্মা রোগীরা এখানে চিকিৎসা পান না।’
ক্লিনিকের ল্যাবরেটরির মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দীপ্তি রঞ্জন সরকার বলেন, ‘যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের জন্য এক্স-রে খুবই প্রয়োজন। এ রোগের জীবাণু থাকে ফুসফুসে। অনেক সময় কফ পরীক্ষা করে তা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তখন এক্স–রের প্রয়োজন হয়। মাসে গড়ে প্রায় দেড় হাজার যক্ষ্মা রোগী এই ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসেন।’
বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের একমাত্র চিকিৎসা কর্মকর্তা শুভেন্দু কুমার দেবনাথ বলেন, ‘১৭টি পদের বিপরীতে জনবল নিয়োগ আছেন ১৩ জন। এখানে মেডিকেল অফিসার ও জুনিয়র কনসালট্যান্টের দুটি পদ রয়েছে। এর একটিতে আমি আছি, আরেকটি পদ শূন্য রয়েছে ১০ বছর ধরে। যক্ষ্মা শনাক্তকরণে মাঠ পর্যায়ে কোনো লোকবল নেই। সহকারী নার্স ও ফার্মাসিস্ট পদ আছে, কিন্তু লোক নেই। গড়ে প্রতিদিন ৬০ জন রোগী আসছে এখানে।’
চিকিৎসা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে ক্লিনিকের চত্বরে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। দিনের বেলায় গেট না থাকায় অনেক সময় পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীর গরু–ছাগল হাসপাতালের মাঠে ঢুকে পড়ে। ক্লিনিকের মূল ফটকের একটি গেটের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এখনো গেট লাগানো হয়নি। অন্যদিকে শহর থেকে একটু বাইরে হওয়ায় ও নৈশপ্রহরী না থাকায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ অরক্ষিত আছে।’
জেলা সিভিল সার্জন মাহ্ফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘ক্লিনিকটিকে ৩১ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতালে রূপান্তর করার জন্য ২০০৭ সালে একটি প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু আজও কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার খবর জানা যায়নি।’
একজন চিকিৎসক দিয়ে সেবাদান কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি নিয়ে মাহ্ফুজার বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। থাকলে তো আমরাও পেতাম। সংকট বলে পাচ্ছি না। শূন্য পদগুলো নিয়ে সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে।’
এদিকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও গত ৬০ বছরে এটিকে হাসপাতালে পরিণত না হওয়ার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন জেলার যক্ষ্মা রোগীসহ বিশিষ্টজনেরা।