লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে তালপাতা-কলাপাতায় লেখা পুথি ও হাতে লেখা কোরআন শরীফ
আব্দুল্লাহ হেল বাকী, (নওগাঁ) :
লাইব্রেরি মানে জ্ঞানের আধার। নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত দুটি শতবর্ষী লাইব্রেরি এখনো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই দুটি লাইব্রেরিতে আধুনিকতার কোন ছোয়া স্পর্শ না করাই অনেকেই যায় না। সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে শত শত বছরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো। দ্রুত এই দুটি ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরির আধুনিকায়ন চায় স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার চাকরাইল গ্রামের কবি তালিম হোসেন চৌধুরী গ্রামের মানুষদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির লক্ষ্যে ১৯৩৬সালে স্থাপন করেন চাকরাইল রিজওয়ান লাইব্রেরি। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে ২১-২২ হাজার বই সংরক্ষিত হয়েছে। রয়েছে তালপাতায় লেখা পুথি ও শত শত বছরের পুরনো বই। অপর আরেকটি লাইব্রেরি হচ্ছে ভাতসাইল গ্রামে অবস্থিত। এই লাইব্রেরিটি মরহুম মোশাররফ হোসেন চৌধুরী এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে স্থাপন করেন ভাতসাইল প্রগতি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রাগঐতিহাসিক আমলের আলিফ লায়লা, তালপাতা, কলাপাতায় ও কাগজে লেখা শত বছরের পুরনো ১৫০ ধরনের পুথি। রয়েছে হাতে লেখা কোরআন শরীফও। এছাড়াও শত শত বছরের পুরনো প্রাচীন আমলের কিতাবসহ বিভিন্ন ধরনের হারিয়ে যাওয়া তৈজসপত্র। এখানে বই রয়েছে প্রায় ২২-২৩ হাজার। কিন্তু বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই ভাতশাইল লাইব্রেরির অবস্থা খুবই নাজুক। কিন্তু দীর্ঘদিন কোন সংস্কার না করায় বর্তমানে লাইব্রেরির টিনশেডের ভবনে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি পড়ে। কাঠের আলমারীগুলো ঘুন পোকায় নষ্ট করছে। ইদুরে বই কেটে নষ্ট করছে এরকম হাজারো সমস্যায় জর্জড়িত। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যদি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী দুটি লাইব্রেরিকে আধুনিকায় ও ডিজিটালায়ন করা হয় তাহলে বর্তমান প্রজন্মের সন্তানরা মোবাইল গেমসে আশক্ত না হয়ে নিয়মিত লাইব্রেরিতে বই পড়ার জন্য আসতো এমনটিই আশা করছেন স্থানীয়রা। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বইয়ের পাশাপাশি এই দুটি লাইব্রেরিতে রয়েছে কয়েক হাজার ইংরেজি সাহিত্যসহ বিভিন্ন ধরনের বই।
ভাতশাইল গ্রামের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান, আব্দুল আউয়াল বলেন শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য আমরা এই লাইব্রেরিতে এসে দেখতে পাচ্ছি। এছাড়াও অনেক পুরাতন তৈজসপত্র সামগ্রীও দেখতে পাচ্ছি যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। যদি এই লাইব্রেরিগুলোকে আরো আধুনিকায়ন করা হয় তাহলে বর্তমান প্রজন্মসহ অনেকেই লাইব্রেরী মুখি হবে। সমৃদ্ধে ভরা বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে তারা অবগত হবে।
ভাতশাইল প্রগতি লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান মুনতাছির আরিফ বলেন, সংরক্ষণের অভাবে বছরের পর বছর অনেক পুরাতন বই, পুথিসহ অন্যান্য ঐতিহ্য গ্রামের বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে অবেহলায় পড়ে ছিলো। আমি নিজ উদ্যোগে বই, পুথি ও অন্যান্য শত বছরের উপকরনগুলো স্থানীয় মানুষের সহায়তায় সংগ্রহ করে পরিত্যাক্ত এই লাইব্রেরিতে আস্তে আস্তে সংরক্ষন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অর্থ ও জনবলের অভাবে জোড়ালো তেমন কিছুই করতে পারছি না। বিশেষ করে লাইব্রেরিটির টিনের কক্ষগুলো দ্রুত মেরামত ও সংস্কার করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, অনেক পুরাতন কাঠের আলমিরাগুলোতে বর্ষা মৌসুমে পানি পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইদুরসহ অন্যান পোকা কাঠের আলমিরাতে থাকা বইগুলো নষ্ট করছে। সরকারের সুদৃষ্টি ও সার্বিক ভাবে সহযোগিতা পেলে শত শত বছরের পুরনো বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক এই নিদর্শনগুলো আগামীর শত শত বছরের জন্য কালের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষন করা সম্ভব হতো।
অপরদিকে চাকরাইল রিজওয়ান লাইব্রেরির নামে শতাধিক বিঘা জমি থাকলেও কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অবৈধ ভাবে তা ভোগদখল করার কারণে উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত এই লাইব্রেরিটি। যদি জমিগুলোর সঠিক ব্যবহার করে তা থেকে আয় হওয়া অর্থ দিয়ে লাইব্রেরিটির অনেক উন্নয়ন করা যেমন সম্ভব তেমনি ভাবে অনেক সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করাও সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তাহলে পূর্ব পুরুষরা যে উদ্দ্যেশ্যে এই লাইব্রেরিটি স্থাপন করেছেন তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর-রশীদ বলেন. আমি সম্প্রতি এই দুটি লাইব্রেরি পরিদর্শন করেছি। বাংলা সংস্কৃতির শত শত বছর আগের অনেক নির্দশন এই লাইব্রেরি দুটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমি দ্রুত সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করার তা করবো।