ওএমএস’র চাল সংকট লাইনে দাড়িয়েও খালি হাতে ফেরত
মোঃ রাজু খান, (ঝালকাঠি) :
করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় যে কঠোর লকডাউন চলমান রয়েছে, তা ওএসএসের লাইনে নিম্ন আয়ের মানুষদের ভিড় বাড়িয়েছে। আর চাহিদা বাড়লেও জোগান না বাড়ায় দীর্ঘ সময় লাইনে দঁাড়িয়ে অনেককে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
বুধবার সকালে বাসন্ডা এলাকার যুব উন্নয়নের সামনে খোলা বাজারে ন্যায্য মূল্যে চাল বিক্রির কেন্দ্রের সামনে থাকা শাহনাজ বেগম জানান, স্বামী পরিবহন শ্রমিক, লকডাউনের কারণে পরিবহন বন্ধ রয়েছে। পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে এক বিপদেই তারা। এসেছিলেন চাল-আটা কিনতে। সকালে বাচ্চাদের সামলিয়ে কেন্দ্রে আসতে ১১টা বেজে যায়। এরপর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দঁাড়িয়ে থাকতে হয়। মাঝে মধ্যে কয়েকদিন চাল কিনতে পারলেও আবার কয়েক দিন তাকে নিষ্ফল হয়ে ফিরতে হয়েছে।
শাহনাজ বলেন, “অনেকদিন হল তার (স্বামী) ডিউটি নাই। এখন তো আয়-রোজগারের কোনো পথও নাই। চারটা বাচ্চা আছে ঘরে। দিনে আড়াই কেজি চাল লাগে।
“আমরা তো খাই শুধু ভাতটাই, অন্যকিছু তো কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নাই। এই চালও ঠিকমতো পাই না। এখানে (ওএমএস কেন্দ্র) একদিন পাইলে আরেকদিন পাই না। খালি হাতে ফেরত যেতে হয়।”
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দীর্ঘ লাইনের পেছনে দঁাড়িয়ে থাকা শাহনাজ কথা বলার সময় অস্থির চোখে সামনে তাকাচ্ছিলেন। বুঝতে চাইছিলেন, আজ পাবেন কিনা।
তিনি বললেন, “আজ ঘরে এক মুঠো চালও নাই। এখানে ১টা বাজলেই চাল শেষ হয়ে যায়। যদি চাল না পাই তাহলে বাইরে থেকে কেনার সামর্থ্য আমার নাই। তখন বাচ্চাগুলোরে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।”
শাহনাজের পরিবারের মতো অনেকেরই লকডাউনের প্রভাবে আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো কম মূল্যে বিক্রি হওয়া সরকারের খোলা বাজার বিক্রি (ওএমএস) দোকানে চাল-আটার জন্য ভিড় করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ওএমএসের ট্রাক ও কেন্দ্রগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর ভিড় আগের তুলনায় দ্বিগুণেও বেশি বেড়েছে। খাদ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ওএমএসের দোকানে কিংবা ট্রাকে ৩০ টাকা কেজিতে চাল ও ১৮ টাকা কেজিতে খোলা আটা বিক্রি করা হয়। এসব কেন্দ্রে থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ পঁাচ কেজি চাল ও পঁাচ কেজি আটা নিতে পারেন।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, ঝালকাঠি জেলা শহরে খোলা বাজারে ন্যায্য মূল্যে চাল ও আটা বিক্রির জন্য ১০জন ডিলার রয়েছেন। ডিলার প্রতি ৫শ কেজি চাল ও ৫শ কেজি আটা বরাদ্দ দেয়া হয়।
অপরদিকে নলছিটি পৌর এলাকায় করোনা মহামারির কারণে বিশেষ সুবিধা দানে ৪জন ডিলার ন্যায্য মূল্যে চাল-আটা বিক্রির জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৩জন ডিলার ক্রমানুসারে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। প্রত্যেক ডিলারে সাড়ে ৪শ কেজি চাল ও ৩শ কেজি আটা বরাদ্দ পাচ্ছেন। যা দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা মেটানো শতভাগ সম্ভব হয় না।
নলছিটি উপজেলায় করোনা মাহারির জন্য আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত ন্যায্য মূল্যে চাল-আটা বিক্রির বরাদ্দ রয়েছে। অথচ কঠোর লকডাউনের বিধি নিষেধ সময়সীমা ১০ আগস্ট পর্যন্ত নিধার্রিত করা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাজার থেকে কম মূল্যে চাল এবং আটা কিনতে এসব ওএসএম কেন্দ্রে সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দঁাড়িয়ে থাকতে হয়। ওএমএস কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি আলাদা লম্বা লাইনে চাল-আটা কিনতে নারী ও পুরুষদের ভিড়।
কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশের পরিবারেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছে। যে কারণে কম দামে চাল-আটা কিনতে সেখানে এসেছে।
কির্ত্তীপাশা বটতলা এলাকা থেকে এসে লাইনে দঁাড়িয়েছিলেন আসা স্বামীহারা আরেক নারী আছিয়া আক্তার। কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে তার চারজনের সংসার।
তিনি বলেন, “সোমবার এখানে এসেছিলাম চাল-আটা কিনতে, পাইনি। পরে বাজার থেকে কিনে নিয়েছিলাম। আজ আবার আসলাম, জানি না পাব কি না?”
অন্যের বাড়িতে কাজ করা আছিয়াও মহামারীর কারণে চাকরি হারিয়ে এখন কম দামে নিত্যপণ্য কেনার লাইনে দঁাড়িয়েছেন।
চালের জন্য লাইনে দঁাড়ানো দিনমজুর মো. হাসান বলেন, “এখন একেবারেই কাজ নাই, যে কয়েকটা টাকা জমানো ছিল, তা নিয়ে আসলাম চাল কিনতে। পাব কি না জানি না?
“দুইদিন এখানে আইসা লাইনে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম, ১টা বাজলে জানালো আজকে মত শেষ, পরের দিন আবার আসতে বলে বিদায় করে দিল। আজকে আবার আসলাম।”
ওএমএসের ডিলারদের দাবি, লকডাউন শুরুর আগে শহরের ১০টি ওএমএস কেন্দ্র ও ট্রাকে যে পরিমাণ বরাদ্দ ছিল, তা বাড়ানো হয়নি। যে কারণে এসব চাল ও আটার চাহিদাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ঝালকাঠি জেলা শহরের ডিলারদের বরাদ্দ বাড়ানো এবং নলছিটিতে সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।
ওএমএস বাসন্ডা কেন্দ্রের ডিলার মো. নান্না মিয়া বলেন, চাল-আটার জন্য কয়েক দিন ধরে ভিড় বেড়েছে। লকডাউনের আগে ততটা ভিড় ছিল না। আগে বিক্রি বিকেল পর্যন্ত চলত, এখন দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
“সরকারিভাবে প্রতিদিন এক হাজার কেজি (১টন) চাল ও এক হাজার কেজি (১টন) আটা বরাদ্দ থাকে। যা প্রতিদিন ৫জন ডিলারের দেয়ার নিয়ম কিন্তু সুষম বণ্টনের দিকে তাকিয়ে ১০জন ডিলারকে ৫শ কেজি চাল ও ৫শ কেজি আটা ন্যায্য মূল্যে বিক্রির জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যতক্ষণ এগুলো থাকবে ততক্ষণ বিক্রি চলবে,” সবার না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি।
ঝালকাঠি খাদ্য অধিদপ্তরের জেলা কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভীর হোসেন জানান, ঝালকাঠি জেলা শহরে ১০জন ডিলারের মাধ্যমে ৫টন চাল ও ৫টন আটা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিকেজি চালের দাম ৩০টাকা ও প্রতিকেজি আটার দাম ১৮টাকা। প্রতিজনে ৫কেজির পণ্য কিনতে পারবে না। পৌর এলাকার সর্বত্র এ সুবিধা দিতে ৫জন ডিলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ১০ জন ডিলার দিয়েই ওএমএস ব্যবস্থাপনা চলছে। অপরদিকে নলছিটিতে ৪জন ডিলারের মধ্যে প্রতিদিন ক্রমানুসারে ৩জন ডিলারে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করছেন। যে পরিমানে বরাদ্দ রয়েছে তাতে চাহিদার সংকুলান হচ্ছে না। অপরদিকে জেলা শহরের কার্যক্রম চলমান থাকলেও নলছিটিতে থাকছে আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবেকুন্নাহার জানান, কয়েকদিন আগে দূর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রাণালয় থেকে করোনায় কর্মহীন মানুষের জন্য যা পেয়েছি তা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কেউ যদি ৩৩৩ তে কল দিয়ে খাদ্য সামগ্রীর জন্য আবেদন করেন তাহলে ঐ ব্যক্তির খাদ্য সামগ্রী দ্রুত তার কাছে পেঁৗছে দেওয়া হচ্ছে।