পাখির নাম জলময়ূর
আব্দুল্লাহ হেল বাকী (নওগাঁ):
বিলের নাম আন্ধাসুরা। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় অবস্থান। শোনা গেল, সেই বিলেই থাকে কয়েক জোড়া জলময়ূর। তাদের সাক্ষাৎ আর ছবি তোলার উদ্দেশ্যে এক দিন ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়া। সঙ্গে রাজশাহীর ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নাইমুল হাসান। বর্ষায় গাড়ি বিলের খুব কাছে যেতে পারেনি।
শ্রীচরণই ভরসা। ক্যামেরা আর ট্রাইপড কাঁধে নিয়ে কাদায় মাখামাখি পথ মাড়িয়ে বিলের পাড়ে যেই পৌঁছলাম, অমনি শুরু হলো বৃষ্টি। ছবি তোলার অবস্থা নেই। ধীরে ধীরে আকাশ কালো হয়ে এল। আশাহত হওয়ার পালা। ভাগ্যিস বিলের পশ্চিম পাড়ে ছিল একটি টংঘর, সেখানেই আশ্রয় মিলল। আধঘণ্টার মধ্যেই বৃষ্টি থেমে পুব আকাশ ফরসা হয়ে এল। আন্ধাসুরা বিলে সারা বছর কিছু না কিছু পানি থাকে, বিলের মধ্যভাগজুড়ে বিশাল এক পদ্মবন, তাকে ঘিরে কচুরিপানার ভেলা, স্থির জলে জন্ম নিয়েছে নানান জাতের ঘন শ্যাওলা। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিলে পাখি শিকার বা পাখি ধরা নিষেধ, চারপাশের গ্রামবাসী তা নিশ্চিত করেছেন। এর সবই জলময়ূরের আবাসের শর্ত।
পদ্ম ফোটে খানিক গভীর জলে। ডিঙি কাছাকাছি যেতেই দেখা পেলাম এক জোড়া জলময়ূরের। জলে ভাসা পদ্মপাতায় পাশাপাশি বসে আছে। অদ্ভুত তার রং। লম্বাটে দেহের পিঠ বাদামি, পেট কালো, মুখ আর পাখার খানিক সাদা, ঘাড়ের পেছন দিক চকচকে সোনালি, ঘাড়ের উজ্জ্বল সোনালি রঙের প্রান্ত ছুঁয়ে লেপটে থাকে এক কালো রঙের রিং। পাখার ওপরিভাগে আবার হলুদ আভা। ঠোঁট কবুতরের মতো সরু। দুই পালকের লেজ দেহের চেয়েও লম্বা, রং বুকের মতো কালচে। এত রঙের সমাহার আমাদের দেশে কোনো পাখির খুব কমই দেখা যায়। লেজের এই বাহার আর জলে বসবাসের জন্যই হয়তো তার নাম হয়েছে জলময়ূর। পায়ের আঙুল বা নখর অস্বাভাবিক লম্বা। পদ্মপাতায় যখন সে বসে বা হাঁটে, নখরগুলো ছড়িয়ে দেয়, ফলে দেহের ওজন পাতাময় ছড়িয়ে যায়, পাতার বুকে ভেসে থাকা সহজ হয়। বেশ কাছেই চলে গেলাম তার। নড়চড় নেই। পালিয়ে যাওয়ার বা লুকানোর প্রবণতা বেশ কম। জলজ উদ্ভিদ, তার পাতা, শ্যাওলা, ছোট পোকামাকড় ইত্যাদি ওদের খাবার।
বর্ষায় পদ্মবনের ভেতর তিন-চারটে ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। পুরুষ আর মেয়ে জলময়ূরের প্রজনন সম্পর্ক বেশ অভিনব। ডিম পাড়া পর্যন্ত জলময়ূর আর জলময়ূরী একসঙ্গে থাকে। এরপরই ময়ূরী জোড়া ছেড়ে চলে যায়, অন্য ময়ূরের সঙ্গে জোড়া বাঁধে এবং আবার ডিম দেয়। পুরুষ জলময়ূর একাকী তা দেয় ছেড়ে যাওয়া ডিমে। বাচ্চা ফোটায় একাকীই। উড়তে শেখা পর্যন্ত বাচ্চাদের খাওয়ায় একা পুরুষটিই। সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসেবে লালন-পালন, নিরাপত্তা সব দায়িত্ব বাবা নেয়। চারপাশে অন্যকোনো পাখির মধ্যে এই প্রবণতা কম।
সেদিন ঝলমলে সূর্যের আলোয় বেশ কিছু ছবি তুলেছি এই দৃষ্টিনন্দন পাখির। তার দেহের বর্ণিলচ্ছটায় মন ভরেছিল আনন্দে। এই আমাদের প্রকৃতি।