যেখানে অমর বীরাঙ্গনা সখিনা ও ফিরোজ খাঁর প্রেম
মশিউর রহমান কাউসার, (গৌরীপুর)
বীরাঙ্গনা সখিনা ও ফিরোজ খাঁর চমকপদ প্রেম কাহিনী অবলম্বনে উপমহাদেশে সৃষ্টি হয়েছে বহুকাব্য, নাটক, গীতিনাট্য ও চলচ্চিত্র প্রভৃতি। এসব কাহিনীতে রয়েছে রোমান্টিকতা, কূটনীতি, অ্যাকশন ও ট্র্যাজেডি। আর সেই অমর প্রেম কাহিনী আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
ঐতিহাসিকদের মতে মোগল আমলে উমর খাঁ ছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কিল্লাতাজপুরের দেওয়ান। তাঁর একমাত্র কন্যা সখিনা ছিলেন রূপ-গুনে অনন্যা ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। সখিনার গুনের কথা ৫০-৬০ মাইল দূরবর্তী বার ভূঁইয়ার অন্যতম পরাক্রমশালী কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীর শাসক ঈসা খাঁর দৌহিত্র সুদর্শন যুবক ফিরোজ খাঁর কানে পৌঁছায়।
এদিকে গুণের কথা শুনে অপরূপ রূপবতী সখিনাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফিরোজের হৃদয়। কিন্তু উমর খাঁর বাড়ীর কঠোর পর্দা প্রথা তার মনোবাসনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফিরোজ আশ্রয় নেন কৌশলের। একদিন এক সুন্দরী খাস বাদীকে তস্বিহ বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার বাসগৃহে পাঠান তিনি। তখন বাদীর মুখে ফিরোজের নানাগুনের প্রসংশা শুনে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত সখিনা নিজের অজান্তেই ফিরোজের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ওই খাস বাদীর সহযোগিতায় দুজনের মাঝে গভীর প্রণয় গড়ে ওঠে।
প্রেমালনে দগ্ধ ফিরোজ খাঁ তার মায়ের সম্মতি নিয়ে সখিনাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান কিল্লাতাজপুর উমর খাঁর দরবারে। উমর খাঁর পক্ষ থেকে উক্ত বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় উভয় পরিবারের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন কিল্লাতাজপুরে। অতর্কিত আক্রমনে ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরন করে উমর খাঁর সৈন্যবাহিনী। শত্রু পক্ষের বিজয়ে কিল্লাতাজপুর গ্রাম নারীশূন্য হলেও ঠাঁই বসে থাকেন সখিনা। এসময় ফিরোজ খা সখিনাকে বাহুবন্দী করে জঙ্গলবাড়ীতে নিয়ে যান এবং তাকে বিয়ে করেন ।
এদিকে উমর খাঁ পালিয়ে গিয়ে দিল্লী মোগল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং কন্যাকে উদ্ধারে সম্্রাটের সাহায্য প্রার্থনা করেন। পরে মোগল স¤্রাট ও আশপাশের হিতাকাঙ্খীগনের সহায়তায় উমর খাঁ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে জঙ্গলবাড়ী আক্রমন করতে অগ্রসর হন। ফিরোজ খাঁ পথিমধ্যে মোগলবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি হন ফিরোজ খাঁ। বন্দি অবস্থায় সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য ফিরোজ খাঁকে চাপ প্রয়োগ করা হলেও তার সাফ কথা ছিল- জীবন থাকতে সখিনার প্রেমের অমর্যাদা করে তালাক দিবেন না তিনি।
এমন সময় হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভূত হয় ১৭-১৮ বছরের এক যুবক। ওই যুবকের নেতৃত্বে ফিরোজের বিপর্যস্ত বাহিনী পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপা নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সৈন্যের ওপর। দুর্ধর্ষ আক্রমনে উমর খাঁর বাহিনী তখন বিপন্ন প্রায়। এমন সময় ঘটল নিন্দনীয় ঘটনা, যা ইতিহাসে কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। উমর খাঁর উজিরের কু-মন্ত্রনায় যুদ্ধের ময়দানে রটিয়ে দেয়া হয়- যাকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ, সেই সখিনাকে তালাক দিয়েছে ফিরোজ খাঁ। আলামত হিসেবে ফিরোজের স্বাক্ষর জাল করা তালাকনামাও দেখানো হলো।
মূহুর্তে পাল্টে গেল যুদ্ধের চিত্র। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন ওই যুবক সেনাপতির মাথা ঘুরছে, দেহ কাঁপছে, ঘোড়ার লাঘাম খসে পড়ছে, তরবারি হয়ে গেছে স্থবির, আস্তে আস্তে নিথর দেহটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তখনই ভূলুন্ঠিত সেনাপতির শিরোস্ত্রাণ খসে গিয়ে বের হয়ে যায় তার মেঘবরণ অপূর্ব কেশরাশি। সবাই দেখল এতক্ষন যে যুবক অভূতপূর্ব রণকৌশলে বীরদর্পে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করছিলেন, তিনি আর কেউ নন উমর খাঁর একমাত্র আদরের দুলালী সখিনা বিবি। খবর পেয়ে ছুটে এলেন বাবা, কলিজার টুকরো কন্যার প্রাণহীন দেহ নিয়ে বিলাপ করতে থাকে। তার ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হতে থাকে। শোকে কাতর উমর খাঁ তখন তার জামাতা ফিরোজ খাঁকে মুক্ত করে দেন।
বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যান ফিরোজ খাঁ। প্রিয়তমার বিয়োগ ব্যাথা কিছুতেই তাকে সুস্থ হতে দেয়নি। একপর্যায়ে একবস্ত্রে গৃহ ত্যাগ করে সন্নাসী হন তিনি। এরপর সখিনার সমাধিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দরবেশরূপী এক ব্যাক্তিকে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকতে দেখে গ্রামবাসী। পরে তারা জানতে পারেন, দরবশেরূপী ওই ব্যক্তিই সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ। ঐতিহাসিকদের মতে, সখিনার কবরের পাশেই মসজিদ নির্মাণ করে ফিরোজ খাঁ বাকী জীবন সেখানে কাটান। মৃত্যুর পর তাকে সখিনার সমাধির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।
মোগল আমলের স্মৃতি বিজড়িত বীরাঙ্গনা সখিনার আবাস ভূমি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান কিল্লাতাজপুর গ্রাম। গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে ১৩ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত এই গ্রামে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা বহু স্মৃতি চিহ্ন আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। কিল্লাতাজপুর গ্রামের কুমড়ী নামক স্থানে অবস্থিত বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি। সমাধির চারপাশে রয়েছে কুন্দ কুসুম নামের ফুলের গাছ। এই ফুল গাছের বয়স কেউ সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারেনা। সংরক্ষণের অভাবে মোগল আমলের অনেক স্মৃতি চিহ্ন আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসী উঁচু টিলা কেটে ফসল ফলাচ্ছে। বনজঙ্গল পরিস্কার করে তৈরী করা হচ্ছে বসতবাড়ী। তারপরও প্রতিদিন অনেক দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসে বীরঙ্গনা সখিনার সমাধি দেখতে।
অতীতে কিল্লাতাজপুর গ্রামটির চারপাশে প্রায় চার মাইল ব্যাপী মাটির উচু প্রাচীর ছিল। ঐতিহাসিকদের কারো কারো মতে সেখানে নাকি ঘোড়দৌঁড় হতো। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে দুই মাইল বিস্তৃত সুরিয়া নদী। নদীর পাশেই রয়েছে যুদ্ধের পরিখা খননের চিহ্ন। স্থানে স্থানে রয়েছে উঁচু মাটির টিলা। রয়েছে সখিনার বাবা কিল্লাতাজপুরের দেওয়ান উমর খাঁর বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। সেসময় প্রায় ২০ একর জমিতে অপূর্ব কারুকার্য মন্ডিত এই বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল। গ্রামের মানুষ উমর খাঁর বাড়ীকে রাজবাড়ী বলে থাকে। এর পেছনে ছিল হাতি রাখার স্থান, যা গ্রামের মানুষের কাছে পিলখানা হিসেবে পরিচিত।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, কিল্লাতাজপুর গ্রামে ছিল তাল, মজা, ছিমু রানী, হাসি, মীরা ও কটুর দিঘী নামে বেশ কয়েকটি বিশাল পুকুর। এগুলোর অধিকাংশই মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গ্রামের আব্দুল্লাহ মিয়ার বাড়ীতে ছিল ৮মন ওজনের ১টি পাথর। জনশ্রুতি রয়েছে- একসময় এই পাথরের সাহায্যে কাগজের মন্ড তৈরী করা হতো। এখনো কিল্লাতাজপুর গ্রামে মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় কারুকার্যময় ইট। অনেক ইটে ফারসি অক্ষরের লেখাও দেখা যায়।
মাওহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রমিজ উদ্দিন স্বপন বলেন ইতিহাসখ্যাত কিল্লাতাজপুর এবং কুমড়ী এলাকাটিকে সংরক্ষণ ও পর্যটন নগরীর আওতায় আনার জন্য স্থানীয় মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে। দেশের উল্লেখযোগ্য জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বীরাঙ্গনা সমাধিস্থল পরিদর্শন কালে শুধু আশার বাণী শুনিয়ে গেলেও তা আজও বাস্তবায়ন হচ্ছেনা।
তিনি জানান, সাহান আরা বানু গৌরীপুরে ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিকে পাকাকরণ এবং এর চারপাশে বাউন্ডারী দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৭ সনে এ সমাধিতে ইউনিয়ন পরিষদের অর্থায়নে তিনি একটি একটি দৃষ্টিনন্দন গেইট নির্মাণ করে দেন। এর পর আর কোন উল্লেখযোগ্য সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি বলে জানান স্থানীয় এই ইউপি চেয়ারম্যান।
গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসান মারুফ জানান, বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিস্থলটিকে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইতিহাসখ্যাত এ স্থানটিকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সকলের সম্মিলত প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
(তথ্যসূত্রঃ ১. গৌরীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী গ্রন্থ, লেখক-অধ্যাপক কাজী এম.এ মোনায়েম, ২. অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ন সচিব ইফতেখার আহামেদ, লেখক রণজিৎ করের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় বীরাঙ্গণা সখিনার কাহিনী, ৩. দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন, তারিখ-২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬।)