রাজশাহীতে প্রায় ৩০ শতাংশ আম বিক্রি হয়েছে অনলাইনে
আমজাদ হোসেন শিমুল, (রাজশাহী) :
রাজশাহী জেলায় এবার ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। সেই হিসেবে রাজশাহীতে প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার ৫২১ মেট্রিন আম উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বাম্পার ফলন হওয়ায় এবার আমের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এবার মোট উৎপাদিত আমের প্রায় ৩০ শতাংশ আম অনলাইনে বিক্রি হয়েছে বলে ধারনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই হিসেবে রাজশাহী থেকে অনলাইনে আনুমানিক ৬৪ হাজার ৫৬ মেট্রিক টন আম বিক্রি হয়েছে। প্রতি মেট্রিক টন আমের মূল্য গড়ে ৮০ হাজার টাকা হলে এবার এখন পর্যন্ত অনলাইনে আমের ব্যবসা হয়েছে ৫১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার।
রাজশাহীর একটি অনলাইন আম ব্যবসার ফেসবুক পেইজ ‘রেইনবো ম্যাঙ্গো স্টেশন’। এই পেইজের এ্যাডমিন বা সত্ত্বাধিকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র মনু মোহন বাপ্পা। বাপ্পা বিজনেজ পোস্টকে বলেন, ‘আমি দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত অনলাইনে গত শুক্রবার (২২ জুলাই পর্যন্ত) পর্যন্ত আম বিক্রি করেছেন ৪২ টন। এতে তার প্রায় ৪০ লাখার ব্যবসা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ১০০ বিঘা আমের বাগান আছে। সবমিলিয়ে হিসেব করে যেটি দেখলাম- ৩০ শতাংশ আম অনলাইনে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, শুধু আমিই না; আমার প্রায় ১৫ জন যাদের নিজস্ব বাগান রয়েছে। করোনার কারণে তারাও নিজেরাই অনলাইনে আম বিক্রয় করেছেন।
নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) তথ্যমতে- রাজশাহী জেলায় সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ১৭৫ জন উদ্যোক্তা অনলাইনে আমের ব্যবসা করছেন। তাদের মধ্যে ১৪০ জন নারী। আর তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় রাজশাহীতে সবমিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে আমের এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে আম বিক্রির বিভিন্ন গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে গ্রুপ, পেজ ও ওয়েবসাইট খুলে সমানতালে আম বিক্রির প্রচার চালিয়ে আমের অনলাইন ব্যবসা করেছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সুবাদে লাইভ করে বাগানের আম দেখানো, আম নামানো এবং প্যাকেটিং কার্যক্রম দেখিয়ে নানাভাবে সব ধরনের ক্রেতাদের নজর কেড়ে ফেসবুকের মাধ্যমেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রাহকরা পছন্দ অনুসারে পাঠিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে ‘রাজশাহী ম্যাংগো প্যারাডাইস’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করে আমের ব্যবসা করছেন। গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার মানুষ আমের অর্ডার করছেন। সে অনুসারে তারা আম সরবরাহ করছেন।
এই গ্রুপের সদস্য নিলয় হাসান বলেন, ‘পেইজে গ্রাহকদের ধরে রাখতে আমের গুটি আসার পর থেকেই সব আপডেট গ্রুপে জানিয়েছি। আম পরিপক্ব হওয়ার পর বাজার অনুসারে দাম ও ছবি দিয়ে আম বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৪২ টন আম অনলাইনে বিক্রি করেছি। যার আনুমানিক মূল্য ৪০ লাখ টাকা। অনলাইনে এসব আমের বেশিরভাগই কুরিয়ারের মাধ্যমে আম সরবরাহ করছি।’
অনলাইনে এবার আমের কেমন ব্যবসা হয়েছে জানতে চাইলে আরেক অনলাইন ব্যবসায়ী রিফাত বলেন, ‘করোনার কারণে অন্য বছরের তুলনায় এবার অনলাইনে আমের শুরুর দিকে ভালো ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে শেষের দিকে এসে গ্রাহকরা আর অনলাইনে আম নিতে ভয় পেতে। মূলত সঠিক সময়ে আম হাতে না পাবার আশঙ্কা থেকেই ক্রেতারা আম কম অর্ডা করেছিল। তারপরও আমি এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত আমি প্রায় ৫ হাজার কেজি আম অনলাইনে বিক্রি করেছি। যার আনুমানিক মূল্য ৪ লাখ টাকা।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জুয়ের মামুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়–য়া ছোট ভাই আলমগীর হোসেনকে নিয়ে অনলাইনে আমের ব্যবসায় মাঠে নেমেছেন। মামুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাবা রিকশা চালাতেন আর আমি টিউশনি করতাম। এতে দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে অনেক বেশি কষ্ট হতো। ৩ বছর আগে কথা। টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম। ওই বছরই ছোট ভাইকে নিয়ে অনলাইনে আমের ব্যবসায় নেমেছি। অনলাইনের মাধ্যমে আম বিক্রিই আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। আম বিক্রির টাকা দিয়ে পাকা (বিল্ডিং) বাড়ি করেছি, গরুর খামার দিয়েছি। এছাড়া বাবার রিকশা চালানো বন্ধ হয়েছে।’ এখন পর্যন্ত এবার প্রায় ১৬ লাখ টাকার ২০ টন আম অনলাইনে বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি।
রাজশাহী মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ঐশী তাবাসসুম ফেসবুকে ‘ম্যাংগোশাহী’ নামের একটি পেইজ খুলে অনলাইনে আমের ব্যবসা করছেন। গত বছর তিনি ৩০০ কেজি গোপালভোগ ও হিমসাগর আম বিক্রি করেছেন। তবে গত বছরের চেয়ে এবার অনলাইনে অনেক বেশি আম বিক্রি করেছেন। গত শনিবার পর্যন্ত ৫ হাজার কেজি আম বিক্রি করেছেন বলে জানান।
রাজশাহী মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নীপা সেনগুপ্তা স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনো ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। অনলাইনে আম বিক্রির সুফল তিনি পেতে শুরু করেছেন। গত শনিবার পর্যন্তÍ ‘অমৃত স্বাদ’ নামের তার ফেসবুক পেইজ এর মাধ্যমে তিনি ক্রেতাদের কাছে ১২ টন আম পাঠিয়েছেন।
এভাবেই রাজশাহীর অনেক শিক্ষার্থী যে যাঁর মতো ফেসবুকে পেজ খুলে লাখ লাখ টাকার আমের ব্যবসা করে বদলে ফেলেছেন নিজেদের জীবন; পরিবারে নিয়ে স্বচ্ছলতা। ‘ইনাগাল ডটকম’, ‘কিনব ডটকম’, ‘রাজশাহীর আম’, ‘স্টোরহাউস অব ম্যাংগোজ’ এমন আরও হরেক রকমের অসংখ্য আকর্ষণীয় নামে ফেসবুকে পেইজ খুলে রাজশাহীর প্রায় দুই শতাধিক তরুণ উদ্যোক্তা এবছর প্রায় ৫১২ কোটি ৪৫ লাখ কোটি টাকার আমের ব্যবসা করেছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কে.জে.এম আবদুল আউয়াল বলেন, জেলায় এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। আমের উৎপাদনও ভাল হয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সেই লক্ষ্যমাত্রাও ছেড়ে যাবে। অনলাইনে কত টাকার আমের ব্যবসা হয়েছে- এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মৌসুম শেষ হলে বলা সম্ভব হবে যে, এই মৌসুমে কত মেট্রিক টন আম উৎপাদান হলো। সেই হিসেবে হয়তো কত টাকার আমের বিকিকিনি হবে সেটাই মৌসুম শেষ হলে বলা সম্ভব হবে। তবে অনলাইনে কত টাকার আমের বিজনেস হয়েছে সেটি ওইভাবে বের করা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর।’
উল্লেখ্য, রাজশাহী জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- গত ১৫ মে থেকে গুটি আম নামান চাষিরা। উন্নতজাতের মধ্যে গোপালভোগ ২০ মে, রানিপছন্দ ২৫ মে থেকে নামানো শুরু হয়। খিরসাপাত (হিমসাগর) নেমেছে ২৮ মে থেকে। এছাড়া ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া আম নামানো শুরু হয়েছে। আম্রপালি এবং ফজলি ১৬ জুন থেকে নামানো শুরু হয়েছে। আর সবশেষে গতী ১৭ জুলাই থেকে নামানো শুরু হয়েছে আশ্বিনা জাতের আম।