গৌরীপুরে জমিদার আমলের নাগলিঙ্গম গাছটি ফুল ফুটিয়ে সৌরভ ছড়াচ্ছে
মশিউর রহমান কাউসার (গৌরীপুর):
ভেষজ গুণাবলির কথা বিবেচনা করে তৎকালীন জমিদার উপেন্দ্র কিশোর রায় প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে বিদেশ থেকে নাগলিঙ্গম গাছটি এনে তার বাড়ির সামনে রোপন করেছিলেন। সেসময় বিভিন্ন পূজায় ব্যবহার হতো এ গাছের ফুল। আর ঔষধি হিসেবে গাছের ফল খাওয়ানো হতো জমিদারদের পোষা হাতিদের। সেই থেকে প্রাচীন নাগলিঙ্গম গাছটি প্রতিবছর নিরবে ফুল ফুটিয়ে সৌরভ ছড়াচ্ছে চারদিকে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানা চত্বরে এককোণে অযত্নে-অবহেলায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিরল এ গাছটি। প্রতিবছর মার্চ মাস থেকে গাছটিতে ফুল ফোটা শুরু হয় এবং এ ফুল থাকে জুলাই মাস পর্যন্ত।
এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, কালীপুরের তৎকালীন জমিদার উপেন্দ্র কিশোর রায় প্রায় দেড়শ বছর আগে অন্যদেশ থেকে অনেকগুলো পামগাছের সাথে এ নাগলিঙ্গম গাছের চারা এনেছিলেন। হাতির পেটের অসুখের প্রতিশেধক হিসেবে ওই গাছের কচিপাতা কার্যকর ভূমিকা রাখত বলে জমিদার এ গাছটি তার বাসভবনের সামনে রোপন করেছিলেন। এ দেশের প্রতিকুল আবহাওয়ায় বাঁচিয়ে রাখতে জমিদার নিজে মালির সাথে সেমসময় গাছটির পরিচর্যা করতেন।
স্থানীয়রা মনে করতেন এ গাছের ফুল নাগ-নাগিনী পাহারা দেয়। এ কুসংস্কারের কারণে প্রতি বছর নাগ পঞ্চমিতে এ গাছের গোড়ায় পূজা করে নাগকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হতো। বর্তমানে পূজা বন্ধ থাকলেও ওই গাছে নাগ-নাগিনী বসবাস করে এ ভয়ে এখনও কেউ এ গাছের আশে পাশে যায় না। নাগলিঙ্গম গাছের ফুটন্ত ফুলের পরাগ কেশর সাপের ফনার মত। আর এ কারণেই গাছটি নাম নাগলিঙ্গম হয়েছে বলে ধারনা করা হয়।
এ গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শাখা-প্রশাখায় কোন ফুল ফোটে না। ফুট ফোটে কান্ডে। এর ফল গোলাকার বলের মত হয়। ফলের রং সফেদার মতো। ফলের ওজন প্রায় ২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেখতে সুন্দর হলেও ফলের স্বাদ খুবই তিক্ত। পশু-পাখিও এই ফল খায় না। নাগলিঙ্গম গাছের পাতার রং গাঢ় সবুজ। দুর থেকে ফুলের সুবাস পাওয়া যায়। কিন্তু ফুলের সুবাস তীব্র নয়। এ গাছের ফলের বীজ থেকে কোন চারা গাছ হয়না। এর ফুল উজ্জল গোলাপী, পাপড়ি গোলাকার কুলী পাকানো। কড়া গন্ধ যুক্ত এ ফুল শুকলে তাৎক্ষণিক মাথা ব্যথা শুরু হয়। কু-সংস্কারের কারণে স্থানীয়রা এ ফুল না ছিড়লেও কবিরাজরা দূর-দুরান্ত থেকে এ ফুল সংগ্রহ করতে এখানে আসেন।
উদ্ভিদবিদদের মতে, দূর্লভ নাগলিঙ্গম গাছের ব্যাপক ওষুধি গুণ রয়েছে। এই গাছের মূল বা শিকর, বাকল, পাতা, ফুল ও ফল থেকে ঔষধ তৈরী হয় এবং এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল ও এন্টিসেপটিক হিসেবে এর নির্যাস ব্যবহার হয়। এর ফুলের কলি দিয়ে রস তৈরি করে খাওয়ালে প্রসূতির সন্তান প্রসব সহজ হয়। এর মাঝবয়সী পাতা দিয়ে তৈরি পেস্ট দাতের পাইরিয়া ও ক্ষয় রোগ নিরাময়ে ব্যাপক কার্যকর। এ গাছের বাকল দিয়ে বহুমূত্র রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। ম্যালেরিয়া, অশ্ব ও বাতব্যথায় নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহার হয়। নাগলিঙ্গমের গাছ থেকে তৈরী হয় পেটের পীড়ার ঔষধ। পাতার রস ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এ গাছের কাঠ অত্যন্ত মজবুত। লালচে বাদামি রঙের এ কাঠ ভারি কাজে লোহার পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়।
স্থানীয় বৃক্ষপ্রেমী মানুষের দাবি গৌরীপুর থানা চত্বরে অবস্থিত দুর্লভ প্রজাতির নাগলিঙ্গম গাছটিকে সংরক্ষণ করা হোক।