করোনায় জীবন-জীবিকার লড়াই
মেহেদী হাসান বাবু :
করোনা ভাইরাস থমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের খোঁজ মেলে। এর পর ২০২০ পেরিয়ে ২০২১ সালে এসেও থামেনি করোনার আগ্রাসন। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ মেলে গত বছরের মার্চে। এর পর থেকেই প্রাণঘাতী ও ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লড়ছে বাংলাদেশ। লকডাউন, সাধারণ ছুটিসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগ চলছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের কঠোর লকডাউনের মতো করে এখনকার লকডাউনগুলো পালিত হচ্ছে না। বরং সেগুলো কখনো সীমিত আকারের লকডাউন কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন ও সীমিত পরিসরে সবকিছু খোলা রাখাসহ নানা কায়দায় পালিত হচ্ছে। এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তবে করোনা ভাইরাস বনাম জীবন-জীবিকার যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটি নিয়ে বিতর্কে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় আলোচনা করতেই হবে। প্রথমত, অর্থনৈতিক কর্মকা- ও জনজীবন স্বাভাবিক করতে বিশ্বের বড় বড় দেশ গত বছরই লকডাউন তুলে নিয়েছে বা শিথিল করেছে। ওই হিসেবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনাসহ সবকিছু চালু করে দেওয়া বা সীমিত পরিসরে চালুর চেষ্টা মোটেও দোষের কিছু নয়। গত বছর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল মানুষকে ঘরে রাখার জন্য। কিন্তু দেশের বাস্তবতায় তা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে যেসব মানুষ দিনে আনে দিনে খায় কিংবা নিম্নআয়ের মানুষ, তাদের জন্য করোনা ভাইরাসের চেয়েও বড় সমস্যা ক্ষুধা ও দরিদ্রতা। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ঘরবন্দি থাকা তাদের কাছে রীতিমতো প্রহসন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে করোনার মতো নজিরবিহীন জনস্বাস্থ্য সংকটে এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে।
দ্বিতীয়ত, কঠোর বিধিনিষেধ কিংবা কঠোর লকডাউনে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার নজির দেখিয়েছে অনেক দেশ। তবে সেসব দেশের জনসংখ্যা, দারিদ্র্যসীমার মাত্রা- কোনো কিছুই বাংলাদেশের সঙ্গে মেলে না। নিম্নআয়ের মানুষের রুটি-রুজি নিয়ে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার কারণে কোনো কিছুই কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। একদিকে যেমন নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব, তেমনি তা বাস্তবায়নেও রয়েছে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা। ফলে নিম্নআয়ের মানুষ মানতে চায় না কোনো বিধিনিষেধ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাদের কাছে ক্ষুধাটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা সংক্রমণের এই বিধিনিষেধ নিয়ে এখন আক্ষরিক অর্থেই মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। একশ্রেণির সচেতন মানুষের দাবি- বিধিনিষেধ আর প্রতিরোধ চেষ্টাই ঠেকাতে পারে করোনার সংক্রমণ। এই দাবি নিঃসন্দেহে যথার্থ। কিন্তু আরেক শ্রেণির মানুষ যখন নিম্নআয় আর স্বল্পআয়ের মানুষের জীবিকার প্রশ্ন তোলে, তখন আর লকডাউন কিংবা সাধারণ ছুটির ব্যাপারটি ধোপে টেকে না। ওইসব মানুষের কাছে এমন উদ্যাগকে নেহাতই বিলাসিতা মনে হয়। করোনা ভাইরাস মহামারী সরকারকে কঠিন আর রূঢ় বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। সংকটটা কেবল রাষ্ট্রের নয়, বৈশ্বিক। তাই সবার মন রেখে করোনা সংকট মোকাবিলা সত্যিই কঠিন। জনবহুল এই দেশের নাগরিকদের জীবন ও জীবিকা সমন্বয়ের চেষ্টাও আরেকটি বড় সংকট হয়ে সামনে এসেছে।
কেবল নামের লকডাউন কিংবা গণপরিবহন বন্ধ করাকেই সমাধান মনে করছেন না অনেকে। তাদের কথা হলো, এসব বন্ধ করেও অনেকাংশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে না। তা হলে চালু রেখে মানুষের জীবন-জীবিকার চাকা সচল রাখতে দোষ কী? তবে বন্ধ রাখা, চালু রাখা- সব ক্ষেত্রেই একটা ব্যাপার মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। করোনা মোকাবিলায় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার কেনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে থ্রি সি মন্ত্র- ‘ক্লোজড স্পেস’, ‘ক্রাউডেড স্পেস’ ও ‘ক্লোজড কন্ট্যাক্ট’ থেকে দূরে থাকা। আর মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করে সাফল্য পেয়েছে অধিকাংশ দেশ। রাষ্ট্র শতচেষ্টা করেও কিছুই করতে পারবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি-আমি সচেতন হই। আপনি, আমি, আমরা যদি নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি- তা হলে আমাদের চারপাশও সুরক্ষিত হয়ে উঠবে। তখন করোনা নিয়ন্ত্রণেও সফলতা আসবে।
মানুষের জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ের বিষয়টি নিয়ে সরকারও চিন্তিত। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণ ওই কথারই প্রমাণ দেয়। ১৩ মের ওই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না। এই ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ করতে হয়েছে। আমরা গত বছর টানা দুই মাসেরও বেশি সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর গত মাসের ৫ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। ফলে অগণিত মানুষের রুটি-রুজির ওপর আঘাত এসেছে। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা গেছে, গত বছর করোনা ভাইরাস আঘাত হানার পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১টি খাতে মোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর অনুদান বাবদ ৮ হাজার ২৬০ কোটি টাকারও বেশি বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর সাময়িক কর্মহীন ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৯১২ কোটি ৫০ লাখ দেওয়া হয়। এ বছরও সমসংখ্যক মানুষকে একই হারে ৯১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬০৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, সাধারণ শ্রমিক, নিম্নআয়ের মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবক, বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিরা এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।
করোনা ভাইরাসের সাধারণ ছুটি আর কঠোর লকডাউন হলেই কঠিন বিপাকে পড়ে যায় একশ্রেণির মানুষ। ছোট ছোট দোকানপাট চালানো ব্যবসায়ী, দিনমজুরসহ নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষকে অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হয়। লকডাউন আর ছুটিতে এসব মানুষকে হয়তো করোনা থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। কিন্তু ক্ষুধা থেকে কে বাঁচাবেন? সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা রয়েছে। কিন্তু সেটি কি সবার কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে? এর চেয়ে বড় কথা, ত্রাণ কোনোভাবেই ক্ষুধার চূড়ান্ত সমাধান নয়। ফলে এসব মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচনোর জন্য সীমিত আকারে সবকিছু খুলে দেওয়া ছাড়া আসলে আর কোনো উপায় ছিল না। করোনা সংক্রমণের হার যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি বেড়ে গেছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আর অসহায়ত্বও। এখন স্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ মেনে যদি ছুটি ও লকডাউন আরও বাড়ানো হয় এবং তখন সমাজের একটা বড় অংশ আরও বিপদে পড়বে ও মনোবল-কর্মনিষ্ঠা হারিয়ে ফেলবে, তা হলে এর দায় কে নেবেন? সবচেয়ে বড় কথা হলো- ক্ষুধা, দরিদ্রতা, বেকারত্ব, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা যে কোনো সমাজব্যবস্থারই শৃঙ্খল ভেঙে দেয় এবং অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়।
করোনা ভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্বব্যবস্থাই নড়ে উঠেছে। একদিকে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নআয়ের, দৈনিক আয়ের ও ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীকে ঠিক রাখতে হবে। না হলে বিপদ বেড়ে যাবে অনেক। করোনার সব আলোচনা একবিন্দুতে গিয়েই মিলছে। সব স্থবির রেখে জীবিকা চালানো যাবে না। আর সব খুলে দিয়ে জীবনকে হুমকির মুখেও ফেলা যাবে না। তাই স্বাস্থ্যবিধি, সরকারি নির্দেশনা ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
(মেহেদী হাসান বাবু : সম্পাদক,আজকের বিজনেস বাংলাদেশ)